সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল পর্যালােচনা কর


প্রশ্নঃ সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল পর্যালােচনা কর।
অথবা, জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল পর্যালােচনা এবং তার ওপর নূরজাহানের প্রভাব আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র সেলিম নূরুদ্দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। ইতিহাসে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর নামেই পরিচিত। তিনি তার পিতার পথ অনুসরণ করে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণপূর্বক ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বারােটি আইন প্রণয়ন করে এর নাম দেন 'দস্তুরুল আমল’। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে তার শাসনামল একটি ঘটনা বহুল অধ্যায়।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালঃ
১. খসরুর বিদ্রোহ দমনঃ জাহাঙ্গীরের শাসনামলের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলাে খসরুর বিদ্রোহ দমন। ক্ষমতালাভের অব্যবহিত পরে যুবরাজ খসরু পাঞ্জাবে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। সম্রাট তার বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশে বের হলে জলন্ধরে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে খসরু জাহাঙ্গীরের নিকট পরাজিত হন।

২. বাংলার বিদ্রোহ দমনঃ ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুঘলদের দ্বারা বিজিত হলেও আফগান দলনেতারা এটা সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ওসমান খা ও মূসা খাঁ মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। জাহাঙ্গীর এ বিদ্রোহ দমন করে বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন এবং এর নাম দেন জাহাঙ্গীরনগর।

৩. কান্দাহার পুনরুদ্ধারে ব্যর্থতাঃ আকবরের রাজত্বকালে পারস্যের শাহ আব্বাস বহু চেষ্টা করেও কান্দাহার পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। অতঃপর তিনি জাহাঙ্গীরের সাথে বন্ধুত্বের অভিনয় করে ১৬১২ সালে কৌশলে আকস্মিকভাবে কান্দাহার অধিকার করেন। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীর শত চেষ্টা করেও তা আর পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।

৪. মেবার অভিযানঃ মেবার বিজয় হলাে জাহাঙ্গীরের শাসনামলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। জাহাঙ্গীর মেবার অধিকারের উদ্দেশ্যে সেখানে উপর্যুপরি আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে তিনি মেবার বাহিনীকে পরাজিত করলেও রাজধানী চিতাের হস্তগত করতে পারেননি। অতঃপর ১৬১৫ সালে যুবরাজ খুররমের নেতৃত্বে মেবার মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

৫ কাংড়া দুর্গ বিজয়ঃ শতদ্রু ও রাভী নদীর মােহনায় অবস্থিত দুর্ভেদ্য কাংড়া দুর্গ বিজয় জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের অপর একটি স্মরণীয় ঘটনা। সেনাপতি মর্তজা খাঁ এ দর্গ জয় করতে ব্যর্থ হন। তখন যুবরাজ খুররম এক বিশাল বাহিনী নিয়ে দুর্ভেদ্য কাংড়া দুর্গ দীর্ঘ চৌদ্দ মাস অবরােধ করে রেখে অবশেষে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে তা জয় করেন।

৬. দাক্ষিণাত্য অভিযানঃ জাহাঙ্গীর ক্ষমতা লাভ করে দাক্ষিণাত্যের দিকে মনােযােগ দেন কিন্তু তার এ মনােযােগ ব্যর্থ হয়। শেষে ১৬১৭ খিস্টাব্দে তিনি যুবরাজ খররমের নেতৃত্বে আহমদনগর অভিমুখে অভিযান প্রেরণ করেন। খুররম কৃতিত্বের সাথে সফল অভিযান চালান। তিনি আহমদনগর দুর্গ ও বালাঘাট অধিকার করেন কিন্তু এ অভিযানের ফল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

৭. মহব্বত খানের বিদ্রোহঃ সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে তার সেনাপতি সহব্বত খান ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। তখন বুদ্ধিমতী সম্রাজ্ঞী নূরজাহান তাকে সামাজ্যের প্রতি বিপজ্জনক মনে করেন। তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সম্রাটকে পরামর্শ দেন। এতে মহব্বত খান বিদ্রোহ করেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাজ্ঞী নরজাহানকে বন্দি করেন। নূরজাহান কৌশলে বন্দিদশা থেকে সম্রাটসহ মুক্ত হলে মহব্বত খান পলায়ন করতে বাধ্য হন।

৮. খুররমের বিদ্রোহ দমনঃ ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন, সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের আর একটি স্মরণীয় ঘটনা হলাে যুবরাজ খুররমের বিদ্রোহ। নূরজাহান চেয়েছিলেন স্বীয় জামাতা এবং সম্রাটের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসাতে, কিন্তু খুররম ওরফে শাহজাহান ছিলেন তুলনামূলক প্রতিভাবান। তিনি পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন, তবে রাজকীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। পরবর্তীতে ফিরে এসে পিতার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে জাহাঙ্গীর তাকে ক্ষমা করেন।

৯. ন্যায়বিচারকঃ জাহাঙ্গীর ন্যায়বিচারক ছিলেন। ধনী দরিদ্র সকলেই যাতে সরাসরি সম্রাটের নিকট বিচারপ্রার্থী হতে পারে সে জন্য তিনি ষাটটি ঘণ্টাযুক্ত একটি সােনার শিকল আগ্রার প্রাসাদ থেকে যমুনা নদীর তীর পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।

১০. সাহিত্যানুরাগীঃ সম্রাট জাহাঙ্গীর শিল্প সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। ফারসি ভাষায় স্বরচিত আত্মজীবনী ‘তুযুকে জাহাঙ্গীরী’ তার সাহিত্যকীর্তির উজ্জ্বলতম নিদর্শন। তিনি ইতিহাস, ভূগােল, জীবনচরিত ইত্যাদি রীতিমতাে অধ্যয়ন করতেন।

১১. সঙ্গীতানুরাগীঃ সম্রাট জাহাঙ্গীর সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ লালন খান ও তানসেনের পুত্র বিলাস খান তার দরবার অলঙ্কৃত করেন।

সম্রাটের ওপর নূরজাহানের প্রভাবঃ
সম্রাজ্ঞী হওয়ার পর নূরজাহান নিজস্ব রূপ লাবণ্য ও প্রজ্ঞা দ্বারা জাহাঙ্গীরের ওপর পুরােপুরি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্যে নূরজাহানের ক্ষমতাই সর্বোচ্চ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে জাহাঙ্গীর ক্রমশ আরামপ্রিয় হয়ে বিলাসিতার স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেন। অন্যদিকে নূরজাহান দিন দিন অভিজ্ঞতা ও শক্তির অধিকারী হতে থাকেন এবং সম্রাটের নামের সাথে তার নামও মুদ্রায় অঙ্কিত হয়। এমনকি সব সরকারি ফরমানে জাহাঙ্গীরের দস্তখতের সাথে তার দস্তখতও থাকত। শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর নূরজাহানের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হন।

নূরজাহানের প্রভাবের ফলাফলঃ নূরজাহানের প্রভাবের ফলাফলকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ক. সুফল ও খ, কুফল ।

ক. সুফলঃ সম্রাটের ওপর নূরজাহানের প্রভাবের সুফল আমরা তৎকালীন শাসন ব্যবস্থা দ্বারা নির্ণয় করতে পারি। নূরজাহান অনেক সময় সম্রাটের বদমেজাজ ও নিষ্ঠুরতা স্বীয় বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিদ্রোহ দমন, সাম্রাজ্য বিস্তার এবং সুষ্ঠ শাসন পরিচালনায় তিনি অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচয় দেন।

খ, কুফলঃ নূরজাহানের প্রভাব যেমন সুফল বয়ে আনে তেমনি এর অনেক কুফলও রয়েছে। তিনি ক্ষমতার লােভে যুবরাজ খুররম শাহজাহানের পরিবর্তে স্বীয় জামাতা এবং সম্রাটের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন। ফলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

উপসংহারঃ সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল ছিল ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার এক ঘটনাবহুল যুগ। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, মুঘল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন এক আকর্ষণীয় চরিত্র এবং তাঁর রাজত্বকাল সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ ছিল। তিনি সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েও শাসনব্যবস্থায় অতুলনীয় অবদান রাখতে সক্ষম হন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক