মুহাম্মদ বিন কাসিমের চরিত্র, কৃতিত্ব ও শাসন ব্যবস্থার বর্ণনা দাও


প্রশ্নঃ মুহাম্মদ বিন কাসিমের চরিত্র, কৃতিত্ব ও শাসন ব্যবস্থার বর্ণনা দাও।
অথবা, মুহাম্মদ বিন কাসিমের চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে যা জান লেখ।

উপস্থাপনাঃ ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসন এতিষ্ঠার ইতিহাসে মুহাম্মদ বিন কাসিমের অবদান চিরভাস্বর হয়ে আছে। মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন একজন মুজাহিদ, খ্যাতিমান সেনানায়ক, রাজনীতিবিদ এবং সুশাসক। তিনি তার রণকৌশল দ্বারা আরব সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটিয়েছিলেন। তাই তিনি ইসলামের ইতিহাসে গৌরবােজ্জ্বল যুগের এক অবিস্মরণীয় কৃতী পুরুষ।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের চরিত্র ও কৃতিত্বঃ মুহাম্মদ বিন কাসিমের অসামান্য পরাক্রম, রণনৈপুণ্য ও সংযত আচরণ মুসলিম সামরিক ইতিহাসে এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। যেসব কাজ তার সুমহান চরিত্র ও অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে সেগুলাে হলাে-

১. তারুণ্যদৃপ্ত ব্যক্তিত্বঃ উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদের শাসনকালে যে ক’জন সেনাপতি যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে আরব সাম্রাজ্যের সীমারেখা সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি অনেকগুলাে যুদ্ধ বিজয়ের কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। তার দুর্জয় মনােবল, রণকৌশল এবং আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা তাকে বিজয়ের গৌরব এনে দিয়েছিল।

২. সুনিপুণ রণকুশলীঃ মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন অত্যন্ত সুনিপুণ ও প্রতিভাবান সেনাপতি। মুলতান ও সিন্ধু অঞ্চলে তার স্বল্প দিনের শাসনকাল এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে। তার সাহসিকতা, বীরত্ব, সমর তৎপরতা ও মহত্ত্ব বিজিত অঞ্চলের জনগণের হৃদয় স্পর্শ করেছিল।

৩. সরলতাঃ রণনীতিতে লৌহমানব মুহাম্মদ বিন কাসিম ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন একজন-মহানুভব নেতা, খােশ মেজাজ ও সহজ সরল মানুষ। তিনি অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন।

৪. মহানুভবতাঃ তিনি ছিলেন একজন মহানুভব সেনাপতি। তিনি পরাজিত শত্রুর সাথে নির্দয় আচরণ করতেন না। আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দিতেন, ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করতেন, তবে প্রতিদ্বন্দ্বীকে কঠোর হস্তেই দমন করতেন। ঐতিহাসিক জুরজানী বলেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম মধ্যযুগের একজন শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

৫. পরধর্মের প্রতি সহনশীলঃ মুহাম্মদ বিন কাসিম পরধর্মের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রক্ষা করেন এবং প্রত্যেককেই নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।

৬. উদার ও সহনশীলঃ ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন উদার ও সহনশীল বিজেতা শাসক। তার রাজ্যের অমুসলিমদের প্রতি তিনি অতিশয় সদয় আচরণ করতেন। তার উদারতার জন্যই পরবর্তীতে হিন্দু সম্প্রদায় তার মূর্তি বানিয়ে পূজা করেছিল।

৭. ইসলামী আদর্শের মূর্ত প্রতীকঃ মুহাম্মদ বিন কাসিম ইসলামী জীবনাদর্শের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়শীল ও বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুসারী ছিলেন। তাই তিনি ভারত উপমহাদেশের বিজিত অঞ্চলে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবােধের সমন্বয়ে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন, যা ছিল এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

৮. অনুপম গুণের আধারঃ মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সুশাসক। তার অনুপম গুণাবলি যুগে যুগে শাসকদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের শাসনব্যবস্থাঃ মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয় মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক চমকপ্রদ অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল। তিনি ইসলামী আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধে সিন্ধ রাজ্যে পদার্পণ করেন। মাত্র তিন বছর তিন মাস তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। এ স্বল্প সময়ে তিনি যে শাসন কায়েম করেছিলেন তা ভারতের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। এ সম্পর্কে ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন- The story of Muhammad Bin Qasim's invasion of Sindh is one of romance of History. তার শাসনব্যবস্থার বিশেষ দিকগুলাে নিম্নরপ-

১. প্রশাসনিক বিভাগঃ সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য তিনি বিজিত অঞ্চলকে বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলায় বিভক্ত করেছিলেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে ‘নাযীর’ এবং জেলা প্রশাসককে “দিওয়ান’ বলা হতাে।

২. রাজস্ব ব্যবস্থাঃ শক্তিশালী অর্থব্যবস্থা গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে তিনি রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করেন। তার শাসনাধীন এলাকায় রাজস্ব আহরণের প্রধান উৎস ছিল ভূমিকর, উশর, যাকাত, জিযিয়া ইত্যাদি। পানি সেচের সুবন্দোবস্ত থাকলে উৎপন্ন শস্যের ২/৫ অংশ এবং সেচের ব্যবস্থা না থাকলে এক চতুর্থাংশ ভূমি রাজস্ব প্রদানের বিধি ছিল।

৩. ধর্মীয় নীতিমালা প্রণয়নঃ তার শাসনামলে কতিপয় সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় নীতিমালা ছিল। সেগুলাের মধ্যে প্রধান নীতি হলাে, “কেউ কারাে ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।” তিনি প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন।

৪. বিচার ব্যবস্থাঃ তিনি তার বিজিত এলাকায় ন্যায়বিচার কায়েমের জন্য বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন। তিনি নিজের বিজিত এলাকা কয়েক ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে একজন ‘কাযী’ নিযুক্ত করেন। কাযীগণ ইসলামী আইন মােতাবেক বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। প্রধান বিচারপতির উপাধি ছিল “কাযীউল কুত”।

৫. প্রতিরক্ষা ও সামরিক ব্যবস্থাঃ তিনি রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে একটি সুনিয়ন্ত্রিত প্রতিরক্ষা ও সামরিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সকল সৈন্য রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল।

৬. জিযিয়া ও যিম্মিঃ তিনি বিজিত অঞ্চলের অমুসলিম অধিবাসীকে আহলে কিতাবের মর্যাদা দিয়ে তাদের যিম্মির অধিকার দিতেন এবং তাদের থেকে সুবিচারমূলক জিযিয়া আদায় করতেন।

৭. জায়গীরদারি ব্যবস্থা প্রবর্তনঃ তিনি বিজিত অঞ্চলে মুসলিম সেনাপতিদের জায়গীর দান করতেন। জায়গীরদার স্বীয় এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িতে নিয়ােজিত থাকতেন এবং প্রয়ােজনে কেন্দ্রীয় সরকারকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য করতেন।

৮. অমুসলিম নাগরিকদের স্বীকৃতিঃ মুখতাসার তারিখ গ্রন্থে ড. তারা চাঁদ বলেছেন, “মুসলিম বিজয়ীরা বিজিতদের সঙ্গে অত্যন্ত সঙ্গত আচরণ করতেন এবং জনগণের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ দেখাতেন। তারা অনেক অমুসলিমকে শাসনকার্যে এমনকি রাজা দাহিরের প্রধানমন্ত্রীকেও স্বপদে বহাল রেখেছিলেন।”

উপসংহারঃ বিপুল তারুণ্যের অধিকারী মুহাম্মদ বিন কাসিম চরিত্র, কৃতিত্ব ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ছিলেন ইতিহাসের এক কিংবদন্তী। তিনি যদি আরাে কিছুকাল সময় পেতেন তা হলে ভারত উপমহাদেশে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করে যেতে পারতেন। ঐতিহাসিক বালাযুরি বলেন, “মুহাম্মদ বিন কাসিমের অকাল জীবনাবসানে সিন্ধুবাসীরা তার জন্য অশ্রু বিসর্জন করেছিল।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক