সুশাসন ও ই-গভর্নেন্স-এর প্রতিবন্ধকতাসমূহ ও উত্তরণের উপায় বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ 
সুশাসন ও ই-গভর্নেন্স-এর প্রতিবন্ধকতাসমূহ ও উত্তরণের উপায় বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার মানুষের চিন্তা-চেতনা, জীবনযাত্রা, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ সকল ক্ষেত্রে নবদিগন্তের উন্মোচন করে চলেছে। বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করার সাধনা থেকে ঘটে প্রযুক্তির বিকাশ। বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আজ মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ও মান পাল্টে দিয়েছে। রাষ্ট্র, সরকার ও প্রশাসনের ওপরও প্রযুক্তির প্রভাব পড়েছে বহুলভাবে। এ প্রেক্ষাপটে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর 'ই-গভর্নেন্স' নামক এক নতুন ধারণার উদ্ভব ঘটেছে। সরকারের কাজকর্মে স্বচ্ছতা, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এখন 'ই-গভর্নেন্স'-এর বিকল্প নেই।


সুশাসন ও ই-গভর্নেন্স-এর প্রতিবন্ধকতাঃ ই-গভর্নেন্স-এর মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা বা অসুবিধা রয়েছে। এগুলো নিম্নরূপঃ


১. সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ ই-গভর্নেন্স-এর সুবিধাগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে সমানভাবে ইন্টরনেট ব্যবহার করতে না। কেননা ইন্টারনেট ব্যবস্থা এখনো ব্যয়বহুল। 


২. ইন্টারনেট হতে প্রাপ্ত তথ্য কতটা নির্ভরযোগ্য তা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে সংশয় থাকে। 


৩. অনেক ক্ষেত্রে সরকারের অনেক গোপন কর্মপন্থা জনমতকে প্রভাবিত ও একমুখী করে থাকে।


৪. ই-গভর্নেন্স বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিবেচেনা ও নির্দেশনা আছে, যেমন- সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব, সাইবার আক্রমণের ভীতি এবং এসব ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যতা আছে তা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। 


৫. রাষ্ট্রীয় নীতির অকার্যকারিতা সুশাসন ও ই-গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। 


৬. সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। 


৭. অনেক রাষ্ট্রের বিদ্যুৎ সমস্যা ই-গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধার সৃষ্টি করে। 


৮. দক্ষ কর্মীর স্বল্পতা ই-গভর্নেন্স প্রতিক্ষার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। 


৯. অবকাঠামোগত সমস্যা ও ই-গর্ভনেন্স-এর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। 


১০. ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী উৎপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যে অনগ্রসরতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। 


১১. সরকার ও জনগণের মধ্যে অতিরিক্ত যোগাযোগের বিভিন্ন রকম নেতিবাচক ফলও রয়েছে। যখন ই-গভর্নে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একটি শক্তিশালী পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়, তখনই জনগণ ব্যাপক মাত্রায় সরকারের সাথে পারস্পরিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলস্বরূপ, যেহেতু সরকার জনগণ সম্পর্কে প্রচুর পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে, সেহেতু জনগ এক ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধহীন হয়ে পড়ে। এ অবস্থা আরো খারাপ পর্যায়ে পৌছলে দেশে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী শাস প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কেননা যখনই জনগণের ব্যাপারে সরকারের কাছে সীমাহীন তথ্য থাকে, তখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হয়। 


১২. ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় হয়। তার বিনিময়ে প্রাপ্ত ফলাফল আশানুরূপ নয়। পরীক্ষামূলক ইন্টারনেট নির্ভর সরকার ব্যবস্থার ফলাফল ও প্রভাব নির্ণয় করা অনেকক্ষেত্রেই কঠিন ও হতাশাব্যাঞ্জক। 


১৩. ই-গভর্নেন্স সেবা ও সুবিধাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে পৌঁছায় না। 


১৪. যেসব মানুষ নিরক্ষর বা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে তাদের জন্য এ সেবা গ্রহণ করা সত্যিই অচিন্তনীয়৷


১৫. ই-গভর্নেন্সের বিরোধিতাকারীরা যুক্তি দেখান যে, এর স্বচ্ছতার বিষয়টি অস্পষ্ট। কেননা সম্পূর্ণ বিষয়টি সরকার নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার জনগণকে না জানিয়েই যেকোনো সময় যেকোনো তথ্য যোগ বা বিয়োগ করতে পারে। 


১৬. জনগণকে না জানিয়ে তথ্য যোগ-বিয়োগ করার কথাকে ধরে নিলে বলতে হয় যে, জবাবদিহিতার প্রশ্নটিও এর ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। 


সুশাসন ও ই-গভর্নেন্স-এর প্রতিবন্ধকতা উত্তরণের উপায়ঃ ই-গভর্নেন্সের প্রতিবন্ধকতাগুলো উত্তরণের উপায় নিম্নরূপঃ

 

১. সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ যেন ই-গভর্নেন্স-এর সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে পারে সেদিকে সচেষ্ট হতে হবে। ইন্টারনেট যেন সহজলভ্য হয় অর্থাৎ কম মূল্যে কেনা যায় বা ব্যবহার করার জন্য হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।

 

২: ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্য যেন নির্ভরযোগ্য হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। 


৩. সরকারের গোপন কর্মপন্থা প্রকাশ পেলে যেন তা বিরূপ প্রভাব না ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।


৪. সাইবার আক্রমণের ভীতি দূর করতে হবে এবং এরূপ আক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 


৫. ই-গভর্নেন্স-এর সুবিধাভোগী জনগণ সরকারের খুব কাছে চলে আসায় তাদের গোপনীয়তা যেন নষ্ট না হয়, তারা যেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধহীন হয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেননা তা নাহলে সরকার স্বেচ্ছাচারী হয়ে পড়বে। 


৬. ই-গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠার সময় মনে রাখতে হবে—এটা করতে গিয়ে যে ব্যয় হবে বিনিময়ে প্রাপ্ত ফলাফল যেন তার চেয়ে বেশি হয়।

 

৭. ই-গভর্নেন্স-এর সেবা ও সুবিধাগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

 

৮. ই-গভর্নেন্স-এর সেবা ও সুবিধাগুলো দেশের নিরক্ষর ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণও যেন ভোগ করতে পারে বা তাদের জন্য সহজলভ্য হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে । ইন্টারনেট সার্ভিসের ব্যয় কমাতে হবে। 


৯. জনগণকে না জানিয়ে কোনো তথ্য যোগ-বিয়োগ বা সংযোজন-বিয়োজন করা উচিত হবে না। 


১০. কোনোভাবেই জবাবদিহিতার প্রশ্নটি যেন অনিশ্চিত হয়ে না পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের জবাবদিহিমূলক মানসিকতা থাকতে হবে। 


১১. আমলাদের মধ্যে জবাবদিহিমূলক মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদেরকে ভাবতে হবে যে তারা জনগণের সেবক, প্রভু নন। 


১২. সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ব্যতীত ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থা চালু এবং তা সফল করা সহজসাধ্য নয়। এজন্য ই- গভর্নেন্স ব্যবস্থাকে সফল করার জন্য সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং তা বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা থাকতে হবে। 


১৩. দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। 


১৪. জনগণকে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশেষ করে প্রযুক্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। 


১৫. টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। 


১৬. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে দক্ষ লোক নিয়োগ করতে হবে। 


১৭. তথ্য ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে আরো মানসম্মত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। 


১৮. তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে সরকারকে ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। 


১৯. কর্মক্ষেত্রে ICT-এর ব্যবহার বাড়াতে হবে। 


২০. সাইবার-অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 


উপসংহারঃ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে 'ই-গভর্নেন্স' এখন সময়ের জোরালো দাবিতে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে সুশাসনও একটি আধুনিক ধারণা। 'ই-গভর্নেন্স' রাষ্ট্রের নাগরিকদের শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করে দিয়ে এবং সেখানে স্বচ্ছতা সৃষ্টি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে দিয়েছে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক