অথবা, জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মতামত ব্যাখ্যা কর।
অর্থবা, নিশ্চল জড়বাদ বা পরমানুবাদ এবং সচল জড়বাদ ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ যথার্থ দর্শনের প্রথম সমস্যা হলাে জড়ের প্রকৃতি নিরূপণ করা। বস্তুত জ্ঞান, বৃদ্ধি ও জাগতিক উনতির পাশাপাশি সভ্যতার ও শিক্ষার উল্লেখযােগ্যভাবে মান উন্নয়ন হয়েছে। আর এ কারণে জড়ের প্রকৃতি নিণয় সমস্যাও জটিল থেকে জটিলতর রূপ ধারণা করেছে। কিন্তু এ জটিলতর জ্ঞানের আলােচনার ভেতরে যে মানব কল্যাণের বাণা লুকায়িত রয়েছে, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। তাই দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা যথার্থই অনুধাবন করেছেন যে, জড়ের প্রকৃতি আলােচনার আগে আমাদের জানতে হবে সাধারণ মানুষ জড় বলতে কী বুঝে?
জড়ের প্রকৃতিতে বিজ্ঞানীদের অভিমতঃ আধুনিক বিজ্ঞানে জড়ের স্বরূপ সম্পর্কে দুটি মতবাদ পাওয়া যায়। এর প্রথমটি হলাে পরমাণুবাদ বা নিশ্চল জড়বাদ। আর দ্বিতীয়টি সচল জড়বাদ। উনিশ শতকের প্রথমদিকে বিজ্ঞানী। ডাল্টন জড়বাদের পরমাণুবাদ বা নিশ্চল মতবাদটি প্রচার করেন। এর প্রায় ১০০ বছর পর অর্থাৎ বিশ শতকের প্রথমদিকে সচল জড়বাদ মতবাদটি প্রচারিত হয়। এবং এমন মতের ত্রুটি-বিচ্যুতির সমালােচনার মাধ্যমে আবার সৃষ্টি হয়ছে। আপেক্ষিকতাবাদ, কোয়ান্টামবাদ ইত্যাদি সচল জড়বাদ।
পরমাণুবাদ বা নিশ্চল জড়বাদঃ উনবিংশ শতকের প্রথমদিকে প্রখ্যাত রসায়নবিদ ডাল্টন (১৭৬৬-১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে) নতুনভাবে আবার পরমাণুবাদের পত্তন করেন। তিনি জড়কে পরমাণুর সৃষ্টি বলে এক নব্য পরমাণুবাদ চালু করেন। অর্থাৎ ডাল্টন গ্রীক দার্শনিক ডিফোসিটাসের পরমাণুবাদই নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ডাল্টনের অভিমতঃ ডাল্টন বলেন, আমারা যেকোনাে জড় পদার্থ ভাঙ্গলে এমন সব অণু পাই, যাদের আর কোনাে মতেই ভাঙ্গা যায় না। এসব অণুকেই পরমাণু বলে। পরমাণুগুলাে একান্তভাবে নিশ্চল ও নিষ্ক্রিয়, এদের কোনাে কোষ নেই। সুতরাং এরা অভেদ্য ও অবিভাজ্য, পরমাণুগুলাে। নিজস্ব কোনাে গতি নেই কিন্তু বাইর থেকে এদের ওপর গতি প্রয়ােগ করলে এরা স্থানান্তর হয়। পরমাণুগুলাের স্বরূপ, রূপ, গন্ধ, রস ইত্যাদি গৌণ গুণ নেই। পরমাণুগুলাের অবস্থান ও পারস্পরিক সংগঠন থেকেই গৌণ গুণের উৎপত্তি হয়। জগতের সমস্ত বস্তুই পরমাণুর সংগঠন ও সংযােজনের ফল। ডাল্টনের এ মতবাদ নিশ্চল জড়বাদ নামে পরিচিত।
ডাল্টন আরাে বলেন যে, পরমাণুগুলাের পরিমান গত পার্থক্য আছে কিন্তু তাদের কোনাে গুণগত পার্থক্য নেই। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, জগতে যে শতাধিক মৌলিক উপাদান আছে, যেমন: হাইড্রোজেন, কার্বন, অক্সিজেন ইত্যাদি প্রত্যেকে কতকগুলাে পরমাণুর সমষ্টিমাত্র। কিন্তু মৌলিক পদার্থগুলাের যেকোনাে একটি পরমাণুর সাথে অন্য যেকোনাে একটি পরমাণুর পরিমাণগত পার্থক্য আছে। যেমন- স্বর্ণ ও লৌহ দুটি ভিন্ন মৌলিক পদার্থ। আর সে কারণেই স্বর্ণ পরমাণু ও লৌহ পরমাণুর মধ্যে পার্থক্য থাকতে বাধ্য। বস্তুত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, হাইড্রোজেন পরমাণু হচ্ছে ওজনে সবচেয়ে হালকা আর ইউরােনিয়াম পরমাণু হচ্ছে সবচেয়ে ভারী। ডালটনের এ পরমাণুবাদ আলােচনার ফলে যে বিষয়টা স্পষ্ট তা হলাে জড়বস্তু ও পরমাণুর মধ্যে একাধিক মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
সচল জড়বাদঃ উনবিংশ শতকের শেষের দিকে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান পরমাণুর নতুন প্রকৃতির পরিচয় পান। তাদের মতে, পরমাণু নিশ্চল নয়, সচল । ফলে জড়বাদের স্থলে তারা সচল জড়বাদ প্রচার করেন। সচল জড়বাদের অপর নাম, তড়িৎ অণুবাদ বা ইলেকট্রনবাদ।
নিউটনের অভিমতঃ পরমাণু সম্পর্কে নিউটন বলেন, পরমাণু শক্তিহীন বা গতিহীন নয়। পরমাণুর আকর্ষণ শক্তি আছে। বিজ্ঞানী বসকোভিচ ও ফ্যারাডের মতে, পরমাণু নিষ্ক্রিয় নয়। প্রতিটি পরমাণু এক একটি শক্তির কেন্দ্র (Center of force) বিশেষ এবং এদের আকর্ষণী ও বিকর্ষণী শক্তি আছে।
লর্ড কেলভিন এর অভিমতঃ কেলভিন-এর মতে, পরমাণু হলাে ইথার সমুদ্রের আবর্তন বা ঘুর্ণি। তা ছাড়া রাদারফোর্ড, বাের, প্ল্যাঙ্ক, মিলিক্যাল প্রমুখ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, একা একটি পরমাণু বৈদ্যুতিক শক্তির এক একটি জটিল সংগঠন এবং পরমাণুগুলাের প্রত্যেকটি আরও ক্ষুদ্রতর উপাদান দিয়ে গঠিত। লােহার পরমাণু ও সােনার পরমাণুর পার্থক্য গুণগত নয়। এদের পার্থক্য তাদের উপাদানের সংখ্যা, গতি ও সংগঠনের পদ্ধতিতে পরমাণুগুলাের উপাদান সবক্ষেত্রেই একই প্রকার। প্রতিটি পরমাণুর মধ্যে একটি নিউক্লিয়াস বা ধনাত্মক বিদ্যুৎ শক্তি আছে এবং এ নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে এক বা একটি ইলেকট্রন বা ধনাত্মক বিদ্যুৎ শক্তি অতি দ্রুত গতিতে চক্রাকারে ঘুরছে। বিভিন্ন পরমাণুর ইলেকট্রনের সংখ্যাও বিভিন্ন। একটি পরমাণুর মধ্যে কতকগুলাে ইলেকট্রন আছে। তার ওপর নির্ভর করে সে পরমাণুর ওজন। হাইড্রোজেন পরমাণু সবচেয়ে হালকা আর একটি মাত্র ইলেকট্রন তার প্রােটনের চারপাশে ঘুরছে। এর তুলনায় ইউরােনিয়াম পরমাণু অনেক বেশি ভারী এবং এর বিরানব্বইটি ইলেকট্রন তার প্রােটনকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে।
জড়ের নিজড়ীকরণঃ বৈজ্ঞানিক জড়বাদের ভিত্তি মজবুত করেছেন বর্তমান অত্যাধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিকগণ। প্ল্যাংক আইনস্টাইন প্রমুখ বিজ্ঞানী সচল জড়বাদের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে জড়ের নির্জড়ীকরণ করেছেন। আপেক্ষিকতাবাদ এবং কোয়ান্টামবাদ প্রাচীন মতবাদের ওপর আঘাত হেনে দীপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করে যে, ভর ও শক্তি দুটি স্বতন্ত্র সত্তা নয় এবং ভরকে শক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা করার কোনাে প্রয়ােজন নেই, বরং ভর শক্তির রূপান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই শক্তিই জগতের মূল উপাদান এবং জড় শক্তিরই এক বিশেষ রূপমাত্র। এই কারণে আধুনিক বিজ্ঞানীদের হাতে পড়ে জড় এবং শক্তির মধ্যের দ্বৈততা দূর হয়ে যায় এবং শক্তিই জগতের আদিম উপাদান বলে পরিগণিত হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক বিজ্ঞান জড় সম্পর্কে অনেক জেনেছে, অনেক নতুন নতুন তথ্য উদ্ভাবন করেছে ও করছে। তাই লর্ড বেলফোর বলেছেন, আমরা আজকাল জড় সম্পর্কে এত বেশি জেনেছি যে, আর জড়বাদে থাকতে পারছি না। আমরা জড়ের সম্পর্কে দারুণভাবে ভাবতে আরম্ভ করছি। কিন্তু এতেই শেষ নয়, এর প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জানতে র্গারাে সময় লাগবে এবং জড়ের আরাে কাছাকাছি যেতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ