শের শাহের চরিত্র ও কৃতিত্বের বিস্তারিত বর্ণনা দাও


প্রশ্নঃ 
শের শাহের চরিত্র ও কৃতিত্বের বিস্তারিত বর্ণনা দাও

উপস্থাপনাঃ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় উত্থান পতনের এক যুগসন্ধিক্ষণে ১৫৪০ সালে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে ধূমকেতুর ন্যায় ভারতের ভাগ্যাকাশে উদিত হন আফগান বীর সূর বংশের স্থপতি শের শাহ। স্বীয় যােগ্যতা ও প্রতিভাবলে দেশের অবকাঠামাে ও যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তার চরিত্র ও কৃতিত্বের প্রশংসায় ঐতিহাসিক কীনী বলেন, No Government not even the British has shown so much wisdom as this Sher Shah.

প্রাথমিক পরিচিতিঃ শের শাহের প্রকৃত নাম ফরিদ খান সুর। তিনি ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাসান সুর ছিলেন আফগান বংশােদ্ভূত।

শের শাহের চরিত্রঃ

১. ধর্মীয় সহিষ্ণুতাঃ অসাধারণ সামরিক প্রতিভা সত্ত্বেও শের শাহ ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও পরধর্ম সহিষ্ণ ছিলেন। কথিত আছে, তিনি প্রত্যহ ভােরে শয্যা ত্যাগ করতেন, নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় ও কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তার সময়ে সকল ধর্মের লােকেরাই স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালন করত।

২. ন্যায়পরায়ণতাঃ ন্যায়পরায়ণতা ছিল শের শাহের চরিত্রের ভূষণ। অন্যায়কে তিনি কঠোর হস্তে দমন করতেন। তার ন্যায়দণ্ড খুবই কঠোর ছিল।

৩. কর্তব্যপরায়ণতাঃ কর্তব্যপরায়ণতা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বিশেষ গুণ। রাজ্যের সার্বিক কল্যাণে তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন। তার এ নিরলস কর্তব্যপরায়ণতার ফলেই রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪. উদারতা ও দানশীলতাঃ উদারতা ও দানশীলতা ছিল শের শাহের অন্যতম স্বভাব বৈশিষ্ট্য। তিনি তার প্রজাসাধারণকে অত্যন্ত ভালােবাসতেন। দুস্থ মানবতার কল্যাণে অকাতরে দান করতেন। এমনকি তিনি জ্ঞানী গুণীদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করতেন।

৫. অন্যায়ের বিরােধীঃ শের শাহ অন্যায় প্রতিরােধ, সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, অসামাজিক কার্যকলাপ, মদ্যপান ও ব্যভিচার বন্ধ করার জন্য কঠোর বিধি-নিষেধ আরােপ করেন।

৬. নিরহংকারঃ শের শাহের চরিত্রের মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার ছিল না। তিনি সর্বসাধারণের সাথে মিলে মিশে কাজ করতে পছন্দ করতেন। যে কেউ তার সাথে নিজের প্রয়ােজন নিয়ে আলােচনা করতে পারত।

৭. হৃদয়বান শাসকঃ শেরশাহ ছিলেন একজন হৃদয়বান শাসক। কারণ দুশমনদের দুঃখেও তার হৃদয় গলে যেত এবং তিনি শত্রুকে অনায়াসে ক্ষমা করতেন।

শের শাহের কৃতিত্বঃ

১. প্রশাসনিক কৃতিত্বঃ শের শাহ জনহিতকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে তার শাসনকাল অত্যন্ত স্মরণযােগ্য হয়ে আছে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা সক্রিয় করে তােলার জন্য সমগ্র সাম্রাজ্যকে তিনি ৪৭টি প্রদেশে বিভক্ত করেন।

২. সংস্কার কৃতিত্বঃ শের শাহ সমগ্র সাম্রাজ্যের অবকাঠামাে সুচারুরূপে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগে প্রভূত সংস্কার সাধন করেন। তার রাজস্বনীতি, অর্থব্যবস্থা, শুল্কনীতি ও মুদ্রানীতি এবং সামরিক বিভাগ ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার সাধন ছিল বিজ্ঞানসম্মত।

৩. সুশাসন প্রতিষ্ঠাঃ শের শাহ ছিলেন একজন সুশাসন প্রতিষ্ঠাকারী। তিনি জনগণের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ১. দিওয়ানে ওজারত, ২. দিওয়ানে আরজ, ৩. দিওয়ানে রিসালাত, ৪. দিওয়ানে ইনশা- এ চারটি বিভাগীয় মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া পরগনা, প্রাদেশিক প্রশাসন ও গ্রামীণ প্রশাসনে বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে নিয়ােগ করেন।

৪. দক্ষ সেনানায়কঃ শের শাহ সামরিক দিক দিয়ে অসাধারণ প্রতিভাধর ছিলেন। তার সামরিক দক্ষতা, রণচাতুর্য ও যুদ্ধ কৌশলের সাথে মুঘলরা পেরে ওঠেনি। চৌসা ও বিলগ্রাম তথা কনৌজের যুদ্ধে বিজয় তার সামরিক দক্ষতার উদাহরণ।

৫. জাতি গঠনে কৃতিত্বঃ শের শাহের বিভিন্ন কৃতিত্বের মধ্যে জাতি গঠন অন্যতম। তিনি তার সুশাসন দ্বারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে যে জাতি গঠন করেন, তা তার রাজনৈতিক পরিপকৃতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

৬. আকবরের অগ্রদূতঃ শের শাহ নিজ প্রতিভা ও কৃতিত্ববলে একটা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলেন। পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট আকবর তার অনেক নীতি গ্রহণ করেন। এজন্য ইবনে বতুতা বলেন, শের শাহের রাজত্বকাল বাদ দিয়ে আকবরের রাজত্বকাল কল্পনা করা যায় না।

৭. স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপােষকঃ শের শাহ জনকল্যাণার্থ স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। সমাধি সৌধ, সূরী রাজধানী, পুনার কেল্লা, কেন্নায়ে কোহলা মসজিদ প্রভৃতি তার অপরূপ স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন।

৮. কল্যাণমূলক কাজে কৃতিত্বঃ জনকল্যাণে রাস্তাঘাট, লঙ্গরখানা, সরাইখানা নির্মাণ, পুলিশ ও গােয়েন্দা বাহিনী গঠন ইত্যাদি শের শাহের শ্রেষ্ঠ জনকল্যাণমূলক কৃতিত্ব।

৯. শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকঃ শের শাহ শিক্ষা ও সাহিত্যের উদার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তিনি তার রাজ্যে অনেক মসজিদ, মাদরাসা নির্মাণ এবং শিক্ষিত ও জ্ঞানী গুণীদের অকাতরে দান করেছিলেন।

১০. সামরিক সংস্কারঃ শেরশাহ গােত্রীয় ভিত্তিতে সৈন্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করে সৈন্য বাহিনীকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করেন। তিনি গােটা বাহিনীকে ৫০ হতে ১০,০০০ ইউনিটে বিভক্ত করেন।

১১. গুপ্তচর প্রথা প্রবর্তনঃ সন্ত্রাস নির্মূলে দেশের বিভিন্ন অংশের সংবাদ সংগ্রহের জন্য শেরশাহ গুপ্তচর প্রথা প্রবর্তন করেন।

১২. সুবিচার প্রতিষ্ঠায়ঃ শেরশাহ সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচারের সময় আমীর ফকীর কোনাে ভেদাভেদ করতেন না। ঐতিহাসিক এরসকিন এ প্রসঙ্গে বলেন, “আকবরের পূর্বে যে কোনাে যুবরাজের চেয়ে শেরশাহ তার প্রজাবর্গের অভিভাবকতু ও আইন প্রণয়নের দক্ষতার জন্য অধিকতর মর্যাদা লাভ করেছিলেন।”

উপসংহারঃ শেরশাহ ছিলেন মধ্যযুগীয় মুসলিম ভারতের ইতিহাসে একজন আদর্শ শাসক। তিনি ভারতের ইতিহাসে উন্নত প্রশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা, জনহিতকর কার্যাবলি এবং যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক