হুমায়ন ও শের শাহের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ দাও এবং এ যুদ্ধে হুমায়নের পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা কর


প্রশ্নঃ হুমায়ন ও শের শাহের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ দাও এবং এ যুদ্ধে হুমায়নের পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, হুমায়ুন ও শের শাহের মধ্যে সংঘর্ষের বিবরণ দাও। এতে শের শাহের সাফল্যের কারণ কী?

অথবা, হুমায়ুন ও শের শাহের মধ্যকার সংঘর্ষের বর্ণনা প্রদানপূর্বক হুমায়ুনের পরাজয়ের কারণগুলাে বিশ্লেষণ কর।


উপস্থাপনাঃ ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের ইতিহাসে হুমায়ুন ও শের শাহের মধ্যকার সংঘর্ষ এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক ঘটনা। এ সংঘর্ষে হুমায়ুনের পরাজয়ের ফলে ভারতবর্ষে বাবরের প্রতিষ্ঠিত মুঘল শাসন সাময়িকভাবে ব্যাহত হলে কিছুদিনের জন্য আফগান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে হুমায়ুনের নির্মম ভাগ্য বিড়ম্বনা ঘটে।

প্রাথমিক অবস্থাঃ Cambridge History of India গ্রন্থ প্রণেতা বলেন, “১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুন পিতার সিংহাসনে আরােহণ করেন।বাবর তার স্বল্পমেয়াদী রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করে যেতে পারেনি। স্থানীয় নৃপতিগণ নিজেদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। এদের মধ্যে শের শাহ ছিলেন অন্যতম।”


হুমায়ুন ও শের শাহের সংঘর্ষের বিবরণঃ

ক. হুমায়ুন ও শের শাহের সংঘর্ষের কারণসমূহঃ সম্রাট হুমায়ুন ও শের শাহের মাঝে সংঘর্ষের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন-

১. আফগান ও মুঘল ক্ষমতার দ্বন্দ্বঃ মুঘল সম্রাট বাবর আফগানদেরকে পরাজিত করে ভারতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এ আফগান মুঘল ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণেই শের শাহ ও হুমায়ুনের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

২. হুমায়ুনের ঈর্ষাপরায়ণ মনােভাবঃ শের শাহের উত্তরােত্তর মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধি এবং বিহারে শের শাহের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও গৌড় বিজয়ের সংবাদে হুমায়ুন শের শাহের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। এমনকি তাকে মােকাবেলা করার জন্য অগ্রসর হন। ফলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।

৩. ক্ষমতা লিপ্সাঃ শের শাহ ও হুমায়ুন উভয়ের মাঝে চরম ক্ষমতা লিপ্সা বিরাজ করে। ফলে উভয়ের ক্ষমতা ও সর্বভারতীয় নেতৃত্বের লােভ সংঘর্ষ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।

৪. সংযমহীনতাঃ তাদের উভয়ের মাঝে সংযমহীনতা বিরাজ করছিল। ফলে তাদের মাঝে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।

খ. সংঘর্ষের ঘটনাঃ

১. শের শাহ কর্তৃক চুনার দুর্গ দখলঃ শের শাহ সাসারামের শাসক থাকাকালীন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আফগানদের সংগঠিত করতে সক্ষম হন। ফলে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে চুনার দুর্গের অধিপতি তাজখানের বিধবা পত্নী লাদ মালেকাকে বিবাহ করে চুনার দুর্গের কর্তৃত্ব লাভ করেন। এতে সম্রাট হুমায়ুন শের শাহের ওপর ক্ষুব্ধ হন।

২. হুমায়ুনের চুনার দুর্গ অবরােধঃ ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন শের শাহের প্রাধান্য বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে চুনার দুর্গ অবরােধ করেন এবং দীর্ঘ ৬ মাস পর্যন্ত অবরােধ করে রাখার পর অবরােধ প্রত্যাহার করে দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করেন।

৩. শের শাহের বঙ্গ বিজয়ঃ ঐতিহাসিক ভি. ডি. মহাজন বলেন, “হুমায়ুন যখন গুজরাটে বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যস্ত, তখন শের শাহ ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় গৌড় আক্রমণ করেন এবং বাংলার অধিপতি গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহের কাছ থেকে প্রচুর ধনরত্ন গ্রহণ করে তার সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন।”

৪. হুমায়ুনের দ্বিতীয় বার চুনার দুর্গ অবরােধঃ হুমায়ুন গুজরাট থেকে প্রত্যাবর্তন করে শের শাহের বঙ্গ বিজয় সম্পর্কে অবহিত হয়ে গৌড় অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরাসরি বাংলা অভিযান না করে চুনার দুর্গ অবরােধ করেন। একাধারে ছয় মাস অবরােধের পর চুনার দুর্গ তার হস্তগত হয়।

৫. শের শাহ কর্তৃক রােটাস দুর্গ ও বাংলা বিজয়ঃ হুমায়ুনের চুনার দুর্গ অবরােধের সুযােগে শের শাহ চুনার দুর্গ রক্ষার ভার সেনাপতি গাজী খানের হস্তে অর্পণ করে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করেন। অতঃপর বিহারের সুরক্ষিত রােটাস দুর্গ দখল করে বিপুল ধনরত্ব লাভ করেন।

৬. হুমায়ুনের বঙ্গ বিজয়ঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করে নামকরণ করেন ‘জান্নাতাবাদ’ এবং দীর্ঘ আট মাস সেখানে বিলাস ব্যসনে নিমগ্ন থাকেন।”

৭. শের শাহের বিহার ও জৌনপুর দখলঃ শের শাহ অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে বাংলাদেশে প্রকাশ্য সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে বিহার ও জৌনপুরে মুঘল শাসনাধীন অঞ্চলগুলাে অধিকার করে কনৌজ পর্যন্ত অগ্রসর হন। এতে বিহার ও দিল্লীর মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলাে শের শাহের হস্তগত হয়।

৮. শের শাহের বেনারস ও চুনার দুর্গ দখলঃ ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, “হুমায়ুন দীর্ঘ আট মাস যখন গৌড়ে অবস্থান করছিলেন, তখন ধূর্ত শের শাহ সুযােগ বুঝে তার হৃত রাজ্য ও চুনার দুর্গ উদ্ধার এবং বেনারসসহ বহু অঞ্চল দখল করেন।”

৯. চৌসার যুদ্ধঃ বিহার ও জৌনপুরে শের শাহের আধিপত্য সম্প্রসারিত হতে দেখে হুমায়ুন বাংলার শাসনভার জাহাঙ্গীর কুলি বেগের ওপর অর্পণ করে সসৈন্যে আগ্রাভিমুখে অগ্রসর হয়ে পথিমধ্যে চৌসায় শের শাহ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন। ফলে ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসায় শের শাহ ও হুমায়ুনের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে হুমায়ুন শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে আত্মরক্ষার্থে নদীতে ঝাঁপ দেন এবং নিজাম নামক এক ভিস্তিওয়ালার সাহায্যে কোনােক্রমে প্রাণরক্ষা করে আগ্রায় গমন করেন।

১০. কনৌজের যুদ্ধঃ হুমায়ুন ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে কনৌজের নিকটবর্তী বিলগ্রাম নামক স্থানে পুনরায় শের শাহের বিরুদ্ধে শেষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। মাত্র ১৫,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে শের শাহ শক্তিশালী মুঘল বাহিনীর মোকাবেলা করে। অবশেষে এ যুদ্ধেও হুমায়ন পরাজিত হয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে শের শাহ মুগল রাজবংশের আধিপত্য খর্ব করে। ভারতে পুনরায় আফগান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

হুমায়ুনের ব্যর্থতা ও শের শাহের সাফল্যের কারণঃ

১. দৃঢ় সংকল্প ও মনোবলের অভাবঃ হুমায়ুনের চরিত্রে দৃঢ় সংকল্প ও মনােবলের অভাব ছিল। অন্যদিকে শের শাহ ছিলেন অসীম সাহসী ও তেজোদ্দপ্ত মনােভাবের অধিকারী। যেখানে শত্রুকে শাস্তি দেয়া প্রয়োজন সেখানে হুমায়ন তাকে ক্ষমা করে দিতো। আর এ দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও মনােবলের অভাবই শের শাহের নিকট তার পরাজয়ের কারণ।

২. দূরদর্শিতার অভাবঃ সম্রাট হুমায়নের অদূরদর্শিতাই শের শাহের সাথে জয়ের প্রধান কারণ। কারণ তার রাজনৈতিক ও সামরিক দূরদর্শিতার অভাব ছিল।

৩. হুমায়ুনের ভাইদের অসহযােগিতাঃ সম্রাট হুমায়ুনের তিন ভ্রাতা কামরান, আসকারী ও হিদাল এবং চাচাতাে ভাই সােলেমান মির্জা বিপদের সময় তাকে সহযােগিতার পরিবর্তে বিরোধিতা করে। শের শাহ এ সুযােগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন।

৪. সামরিক প্রতিভার অভাবঃ শের শাহ অসাধারণ সামরিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। পক্ষান্তরে হুমায়ুনের সামরিক দক্ষতা ততটা উন্নত ছিল না। তাছাড়া হুমায়ুনের শাসনামলে সৈন্যদের উন্নত প্রশিক্ষণেরও অভাব ছিল।

৫. চারিত্রিক দুর্বলতাঃ ক্রমাগত মদ্যপানের কারণে আফিমসেবী হুমায়ুনের মানসিক চৈতন্য ঠিক থাকত না। তাই তার এ চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হতাে না।

৬. সিদ্ধান্তহীনতাঃ স্থির সিদ্ধান্ত ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে হুমায়ুন তার বিজয়গুলাে ধরে রাখতে পারেননি। কারণ তিনি কোনাে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পূর্বেই আরেকটি পরিকল্পনা হাতে নিতেন।

৭. হুমায়ুনের অর্থ সংকটঃ রাষ্ট্রীয় আয়ের উপযুক্ত অঞ্চল সিন্ধু ভাই কামরানকে ছেড়ে দেয়ায় হুমায়ুনের রাজস্ব আয় কমে যায়। ফলে বিভিন্ন যুদ্ধাভিযানে প্রয়ােজনীয় অর্থের যােগান দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

৮. শের শাহের রণনৈপুণ্যঃ শের শাহ এক সময় মুঘল সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকায় এ বাহিনীর নীতি নির্ধারণী কৌশলাদি সম্পর্কে তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। তার এ জ্ঞান পরবর্তীতে মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা করেছিল।

৯. শের শাহের বহুমুখী প্রতিভাঃ হুমায়ুনের বিরুদ্ধে শের শাহের সাফল্যের মূল কারণ ছিল বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা, কর্মশক্তি, দৃঢ় সংকল্প ও নিপুণ যুদ্ধ পরিচালনা নীতি এবং উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা।

১০. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীঃ শের শাহের অধীনে এক বিশাল সশঙখল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং অভিজ্ঞ ও দক্ষ সেনাবাহিনী থাকায় তিনি জয় লাভ করেন।

১১. উত্তরাধিকার নীতির অভাবঃ হুমায়ুনের ব্যর্থতার আরেক কারণ ছিল উত্তরাধিকার নীতির অভাব। তিনি বাবরের নিকট থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যা লাভ করেন। তা ছিল অস্থায়ী ও অনিশ্চিত।

১২. সৈন্যদের শৃঙ্খলার অভাবঃ সৈন্যদের নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার অভাবও হুমায়ুনের পরাজয় এবং শেরশাহের সাফল্যের অন্যতম কারণ।

উপসংহারঃ বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েও হুমায়ন প্রয়ােজনীয় বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তব জ্ঞান এবং ব্যক্তিগত অযােগ্যতার কারণে তা রক্ষা করতে পারেননি। তাই ঐতিহাসিক ত্রিপাঠী বলেন- Humayun was also the victim of his fate.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক