সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ
 সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ বর্ণনা কর। 

ভূমিকাঃ মানুষের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রাষ্ট্র বা সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তিগণকে বৃহত্তর বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হয়, যার উপর একটি সংগঠন, সংস্থা বা একটি জাতি নির্ভরশীল থাকতে পারে। সিদ্ধান্তের উপযুক্ততা, শ্রেষ্ঠত্ব ও কুশলতার উপরও নির্ভর করে অনেকের ভাগ্য। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয় আর কমই আছে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সমাজবিজ্ঞানীদের নিকট এক অন্যতম অধ্যয়নের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বা জাতিগতভাবে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যারা বিশ্বের মানব সম্প্রদায় বিষয়টির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। কারণ যুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রকম জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নির্ভুল ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরো অনেক বেশি অনুভূত হয়ে চলেছে। তাই হার্বার্ট সাইমন (Herbert Simon) সিদ্ধান্ত গ্রহণকে 'Heart of Administration' বলে অভিহিত করেছেন। একজন প্রশাসকের যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে তার মধ্যে প্রধানতম হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ। দৈনন্দিন কাজের বৃহত্তর অংশ হিসেবে তিনি নানান জটিল ও কঠিন বিষয় ও পরিস্থিতিতে অনেকগুলো বিকল্পের মধ্য হতে সর্বোত্তম সিদ্ধান্তটিকে স্থির করতে হয়। আর কোন পরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপই হলো সিদ্ধান্ত। তাই এ সমস্ত দিক বিবেচনায় রেখে বলা যায়, প্রশাসককে ব্যক্তিগত অনেক গুণ, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের অধিকারী হওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ, একটি বিশেষ সময়ে যত ধরনের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তার কাজ চলুক না কেন ফলাফলের জন্য তাকে তার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে হয়।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ (Expansional Factors in Decision Making): দুই ধরনের উপাদানসমূহ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করে। এগুলো হলো নেতিবাচক উপাদান ও ইতিবাচক উপাদান। নিচে এগুলোর বর্ণনা দেয়া হলোঃ

(ক) নেতিবাচক উপাদানসমূহঃ তথ্যের অভাব ও অপর্যাপ্ততা, বস্তুনিষ্ঠ উপাদান, অপ্রত্যাশিত ফলাফল, নিমজ্জিত মূল্যের সমস্যা, রুটিন মাফিক কাজে অতি ব্যস্ততা, সমস্যার সময়মত সমাধান উদ্ভাবনে ব্যর্থতা, বিকল্প কর্মপন্থা থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত বেছে নেয়ার সমস্যা, অজ্ঞতা, পক্ষপাতিত্ব প্রভৃতি সিদ্ধান্ত প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করে।

১। বস্তুনিষ্ঠ উপাদানঃ বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, প্রশাসকগণ সিদ্ধান্ত প্রণয়নে বিশেষ চিন্তাভাবনা না করেই কোন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এ প্রসঙ্গে একজন ব্যবসায়ী মন্তব্য করেছেন যে, “আমি যতবারই চিন্তা করেছি, ততবারই শুধু আমার টাকা খরচ হয়েছে।” সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সম্পর্কে জরিপ চালিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, কিভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তা তারা জানেন না। এরূপ ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই অনুমানের উপর সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করা হয়।

২। ব্যক্তিগত মতামতঃ সিদ্ধান্ত প্রণয়নে ব্যক্তিগত মতামত পছন্দ বা অপছন্দ বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। কোন একটি বিষয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া গেলেও বা অনেক বিকল্প প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও দেখা যায় যে, একজন প্রশাসক এগুলোকে উপেক্ষা করে তার ব্যক্তিগত মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছেন বা গ্রহণ করেছেন।

৩। নিমজ্জিত মূল্যের সমস্যাঃ নিমজ্জিত মূল্য বলতে অতীত খরচ ও বিনিয়োগকে বুঝায় অতীতে যা খরচ হয়েছে আর পুনরুদ্ধার করা যায় না। নিমজ্জিত খরচ হলো স্থায়ী খরচ এবং ভবিষ্যৎ কার্য ব্যবস্থা বা সিদ্ধান্তের জন্য এটি অপ্রাসঙ্গিক। একজন প্রশাসক যদি কোন এক সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে যন্ত্রপাতি বা দালানকোঠা নির্মাণ কাজে মোটা অর্থ ব্যয় করে ফেলেন, তাহলে অন্য কোন কাজে হাত দিয়ে যত অর্থাভাবের মধ্যেই তিনি পড়ুন না কেন চট করে তিনি সে টাকাটা পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করে বর্তমান প্রয়োজনে খরচ করতে পারবেন না। এরূপ ক্ষেত্রে পূর্বের বিনিয়োগ সম্পর্কে ভাবনা ছেড়ে দিয়েই বর্তমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে তিনি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। একজন ব্যক্তিকে একটি পেশাভিত্তিক জীবন বেছে নিতে হলে তাকে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে হয় এবং এ জ্ঞানার্জনের পর হঠাৎ করে একটি পেশা বেছে নেয়া সম্ভব হয় না। এখানে তার পেশা বদল প্রবণতা অতি বেশি মূল্যের দ্বারা সীমিত। কেননা এ বিশেষ জ্ঞানার্জন করতে তাকে যথেষ্ট সময়, শক্তি ও অর্থ খরচ করতে হয়েছে এবং এ অর্থ প্রত্যাহার করে অন্য কোথাও বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি মোটরগাড়ি তৈরির কারখানাকে রাতারাতি একটি ক্রিম তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত করা যায় না।

৪। অপ্রত্যাশিত ফলাফলঃ মারটনের মতে, কোন কোন মূল্যবোধের বাস্তবায়ন মূল্যহীনতারই সৃষ্টি করে। কোন কিছু পেলে বা অর্জন করলে অনেক সময় মনে হয় যে, এটি না পেলেই ভাল হত। কিছু সংখ্যক লোকের মতে, এটি বিয়ে করার মত। বিয়ের সাথে বিচ্ছেদের হারও বাড়ছে। যে উদ্দেশ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল তা যদি অর্জিত না হয় বা ফলাফল সন্তোষজনক না হয় তাহলে তাকে যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত বলা যায় না।

৫। অধিক ব্যস্ততাঃ সরকারি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে, একজন প্রশাসক যদি দৈনন্দিন রুটিন মাফিক কাজে অধিক সময় ব্যয় করেন তাহলে তিনি দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা স্থগিত রাখেন। কেননা এতে যে পরিমাণ মনোযোগ প্রয়োজন তা তিনি দিতে পারেন না। প্রফেসর মার্চ এরূপ অবস্থাকে গ্রেশামের পরিকল্পনা সূত্র (Greshams Law of Planning) আখ্যায়িত করেছেন। প্রফেসর মার্চ আমেরিকার কানিজ টেকনোলজিক্যাল ইন্সটিটিউট-এ দু'বছর গবেষণা চালিয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, কার্যনির্বাহীদের রুটিনমাফিক কাজে তাদের নির্ধারিত সময়ের এক-তৃতীয়াংশ সময় ব্যয় করার স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তারা অধিক সময় ব্যয় করেছেন এবং পরিকল্পনা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের জন্য খুব কম সময়ই রেখেছেন। কিন্তু কাজের চাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা পরিকল্পনায় প্রকৃতপক্ষে কোন সময়ই ব্যয় করতে পারছেন না।

৬। সমাধান উদ্ভাবনে ব্যর্থতাঃ একজন প্রশাসককে একই সময়ে অনেক সংখ্যক বিবিধ কার্য সম্পাদন করতে হয়। যেমন : কোন কারণে অন্য সংগঠনে কর্মরত প্রতিপক্ষের নিকট চিঠি লেখা, নিজ বিভাগের জন্য বাজেট তৈরি, অধীনস্থ কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ এবং ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে কোন সভা বা বৈঠকের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ প্রভৃতি। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রয়োজন মত সময় দিতে তিনি অপারগ। তাছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও তাকে তাড়াহুড়ার মধ্যে তা করতে হয় বলে সিদ্ধান্তে অনেক ভুলভ্রান্তি থেকে যায় এবং সময় মত সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব হয় না।

৭। সঠিক সিদ্ধান্ত বেছে নেয়ার সমস্যাঃ সিদ্ধান্ত কেবল পদ্ধতিগত দিক থেকে সিদ্ধ হলেই সঠিক সিদ্ধান্ত বেছে নেয়া যাবে-এরূপ ভাবার কোন কারণ নেই। সিদ্ধান্ত মূল্যায়নে পদ্ধতিগত নিয়ম যেমনঃ যথাযথ কর্তৃপক্ষ, দক্ষতা এবং মিতব্যয়িতা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য আরো উচ্চতর পরীক্ষা ও বিবেচনা প্রয়োজন। জনস্বার্থ, সাংবিধানিক লক্ষ্য ও নৈতিক মূল্যবোধের সাথে সিদ্ধান্ত সঙ্গতিপূর্ণ কি না সেটাও লক্ষ্য করা প্রয়োজন।

৮। পক্ষপাতিত্বঃ প্রশাসনে পক্ষপাতিত্ব বলতে যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে অযৌক্তিক আচরণকে বুঝায়; পক্ষপাতিত্ব সচেতন বা অসচেতন, ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক যে কোন ধরনের হতে পারে। প্রশাসনে পক্ষপাতিত্ব বলতে কোন একটি বিভাগীয় রীতিনীতি, নিয়ম, ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নেয়া হয়েছে কি না ইত্যাদিকে বুঝায়। এগুলো পরস্পরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলে প্রশাসনের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অতি সহজ হয়। কিন্তু একটির সাথে অপরটির সংঘাত ঘটলেই সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সমস্যা দেখা দিবে। যেমন : প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন উপেক্ষা করা হলে প্রশাসনে স্বেচ্ছাচারিতা পরিলক্ষিত হবে। আবার নিয়মকানুন অনমনীয় হলে গড়িমসি বা লালফিতার শাসন কায়েম হবে। এ ক্ষেত্রে দু'টি পক্ষই সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত প্রণয়নের জন্য প্রতিবন্ধক। কাজেই প্রশাসকের জন্য বড় সমস্যা হচ্ছে সংঘাতপূর্ণ স্বার্থ ও মনোভাবের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করা। এটিই হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা।

(খ) ইতিবাচক উপাদানসমূহঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইতিবাচক বা সহায়ক প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলো হচ্ছেঃ

১। সহজ পরিকল্পনা পদ্ধতি।

২। অনিশ্চয়তা ও দুঃসময়ের জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন।

৩। সাংগঠনিক লক্ষ্য কাঠামো।

৪। যোগাযোগ ব্যবস্থা।

৫। কর্মকাণ্ড গবেষণা পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ৷

৬। ঘটনার পুনঃপরীক্ষা ও বিশ্লেষণ।

৭। গণদাবির গুরুত্ব।

৮। নৈতিকতার গুরুত্ব এবং

৯। অর্থনৈতিক সামর্থ্য।

১। সহজ পরিকল্পনা পদ্ধতিঃ সহজ পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের একটি উপায় হলো নির্ধারিত পদ্ধতি-মান মেনে চলা। প্রশাসকগণ পূর্বনির্ধারিত মানের ভিত্তিতে কোন কোন কাজ পরিমাপ করেন এবং এগুলোকে মোটামুটি শুদ্ধ বলে গ্রহণ করেন। একজন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নির্ধারিত মানের ভিত্তিতে একজন লোক ঘণ্টায় কি পরিমাণ কাজ করতে পারেন, কি ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন এবং কত সংখ্যক লোককে তত্ত্বাবধান করতে পারেন, সে সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা করতে পারেন। এরূপ পদ্ধতি সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক বাহিনীতে প্রতিটি কাজের জন্য নির্ধারিত নিয়ম পদ্ধতি রয়েছে এবং সেভাবে প্রতিটি কাজ তত্ত্বাবধান করা হয়।

২। অনিশ্চয়তা ও দুঃসময়ের জন্য ব্যবস্থাঃ প্রশাসনিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে গেলে ভবিষ্যতে কি ধরনের খরচ হতে পারে সে সম্পর্কে চিন্তা করা প্রয়োজন এবং অনেক সময় দেখা যায় যে, বর্তমান পরিকল্পনা অদৃশ্য ঘটনার জন্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। একজন প্রশাসক সম্ভাব্য পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিকোণ থেকে পরিকল্পনা এমনভাবে প্রণয়ন করবেন যাতে ভবিষ্যতে কোন বিপদ দেখা দিলে তা কাটিয়ে উঠার জন্য পরিকল্পনা কাঠামো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

৩। সাংগঠনিক লক্ষ্য ও কাঠামোঃ সংগঠনকে কার্যকরী করে তোলার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি সংগঠনের লক্ষ্য, নীতি ও নিয়মাবলি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ এবং তা প্রতিটি সদস্যকে জানানো প্রয়োজন। লক্ষ্য, নীতি ও নিয়ম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো সংগঠনে কর্মরত ব্যক্তিদের প্রশাসনিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা। কোন বিশেষ বা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তাদেরকে কি করতে হবে তা সংগঠনই নির্দেশ দেয়। সংগঠন সবসময়ই এর সদস্যদেরকে বুঝাতে চায় যে, সংগঠনের উদ্দেশ্য বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত এবং এ কারণেই সংগঠনের উদ্দেশ্য গ্রহণ করা উচিত। সুতরাং এরূপ ক্ষেত্রেই যায় যে, সাংগঠনিক মূল্যবোধই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার নৈতিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। সাংগঠনিক মূল্যবোধ একটি বিবেকের ভূমিকা পালন করে এবং একজন ব্যক্তির আচরণ পরিচালনা করে। সিদ্ধান্ত প্রণয়নে যৌক্তিকতা বৃদ্ধি করার আ একটি সাংগঠনিক পদ্ধতি হলো একটি কাঠামো স্থাপন এবং কাঠামোর প্রতিটি একক এবং ব্যক্তির মধ্যে যোগ্যতা অনুসারে কাজ ও দায়িত্ব বণ্টন। কর্তৃত্ব এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে সিদ্ধান্ত যথাযথ পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়। অবশ্য সাংগঠনিক কাঠামো স্বয়ং এমন একটি প্রক্রিয়া যা যথাযথ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করে।

৪। যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ বিস্তৃত যোগাযোগ ব্যবস্থা যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রণয়নের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে। সংগঠনকে একটি জালের ন্যায় বিস্তৃত যোগাযোগ ব্যবস্থাকেন্দ্র বলা যেতে পারে। সংগঠনের মাধ্যমেই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য নির্বাচন করা হয় এবং নির্বাচিত তথ্যকে পদসোপানভিত্তিক কার্যকেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। এতে প্রযুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেযার সম্ভাবনা অনেক বেশি বেড়ে যায়। কারণ তথ্য ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সম্ভব নয়। প্রত্যেক সংগঠনেই একটি কেন্দ্রীয় সংবাদ গ্রহণ কেন্দ্র থাকে। এ কেন্দ্রে সকল সংবাদ সংগ্রহ করা হয় এবং পরে বিভিন্ন স্থানে তা প্রেরণ করা হয়। কোন কোন সংগঠনে অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড সংশোধন করার মত ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে যুক্তিসিদ্ধ আচরণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠে। এ পদ্ধতি সাইবারনেটিক বা যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশ্লেষণ পদ্ধতি নামে পরিচিত।

৫। কর্মকাণ্ড গবেষণা পদ্ধতিঃ কোন কোন সমস্যা নিরূপণে এটি খুব কার্যকর ব্যবস্থা। কৰ্ম গবেষণার বিশিষ্ট দিক হলো সমস্যাকে গাণিতিক ফর্মূলার মাধ্যমে প্রকাশ, ফলাফল সৃষ্টিকারী উপাদানের অনুগত পরিমাণ এবং ফলাফলের মূল্যায়ন। উচ্চতর জটিল সমস্যা নিরূপণে কর্মকাণ্ড গবেষণা পদ্ধতির ব্যবহার ইলেকট্রনিক কম্পিউটার সম্ভব করে তোলে।

৬। ঘটনার পুনঃপরীক্ষা ও বিশ্লেষণঃ একটি সিদ্ধান্ত যাচাই করার পদ্ধতি হচ্ছে একটি প্রস্তাবিত কাজের দোষ ত্রুটি সমালোচনা করার উদ্দেশ্যে একজন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা। তার কাজ হবে প্রস্তাবের বিপক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা। ঘটনার যুক্তি এবং মূল্যবোধ প্রভৃতি কারণে একটি সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা যায়। সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নানা ধরনের প্রশ্ন অভিযোগ এবং আপত্তি উঠতে পারে কিন্তু এরূপ অভিযোগ বা আপত্তি যখন সিদ্ধান্তের কাছে হার মেনে যায় তখন তাকে সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত বলা যায়। একটি সিদ্ধান্তের ফলাফলকে যতবেশি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করা হবে, সিদ্ধান্তটি ততবেশি প্রজ্ঞা ও বাস্তবতার নিরিখে গৃহীত বলে বিবেচিত হবে।

৭। গণদাবির গুরুত্বঃ জনগণের কল্যাণের জন্য যেহেতু প্রশাসন ও এর নীতি সিদ্ধান্তসমূহ, তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অথবা, বাইরে থেকে চাপানো মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতি রেখে চলা একান্ত আবশ্যক। সুতরাং যে কোন প্রশাসনিক সংস্থাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গণদাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। তবে প্রশাসনিক সংস্থাকে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে অনুকূল মূল্যবোধ বা জনসমর্থন সৃষ্টি করতে হবে।

৮। নৈতিকতার গুরুত্বঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলোর মধ্যে নৈতিকতার গুরুত্ব অত্যধিক। অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নৈতিকতাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ অথবা বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রায়শই উপেক্ষা করতে হয়। তাই এমন অবস্থায় বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। নৈতিক মূল্যবোধই এসব ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

৯। অর্থনৈতিক সামর্থ্যঃ বর্তমান যুগ গড়ে উঠেছে অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। অর্থ ছাড়া কোন কিছুই সম্ভব নয়। সুতরাং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হয়। কেননা অর্থের সংস্থান ছাড়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিকল্প কর্মপন্থা, ব্যয় এবং উপকার এ দু'য়ের অনুপাতে মূল্যায়ন করতে হয়। স্বল্প ব্যয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত বেছে নেয়াটাই উৎকৃষ্ট সিদ্ধান্ত।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্রতিটি সংগঠন ও প্রশাসনে নীতি প্রণয়ন করা এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার বিভিন্ন পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাবগুলো দূর করা একান্ত প্রয়োজন। তাছাড়া একজন প্রশাসক বা কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিল প্রক্রিয়ায় বিভিন্নমুখী উপাদানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেই তার দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপরই সংগঠন তথা প্রশাসনের সফলতা নির্ভলশীল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক