আইনের আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর


প্রশ্নঃ আইনের আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর এবং এর মূল্যায়ন কর। 

উত্তরঃ আইনের সংজ্ঞার উপর আইনের উৎস নির্ভরশীল। আইনের সংজ্ঞার ব্যাপারে আইনবিদগণ এখনো ঐকমত্যে পৌছতে সক্ষম হন নাই। সেজন্য আইনের উৎস সম্পর্কে ও আইনবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেন, সার্বভৌম ক্ষমতা অর্থাৎ রাষ্ট্র হচ্ছে আইনের উৎস, কেননা এখান থেকেই আইন তার শক্তি বা বৈধতা অর্জন করে। আবার কারো মতে, আইনের কারণ সমূহই আইনের উৎস। উৎসগুলি দু'ভাগে ভাগ করা হয়— আনুষ্ঠানিক উৎস ও বস্তুগত উৎস। বস্তুগত উৎসগুলি আবার দু'ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন- (১) আইনগত উৎস (Legal source) এবং (২) ঐতিহাসিক উৎস (Historical source)। যে সকল উৎস আইন দ্বারা স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং আদালত কর্তৃক প্রয়োগ হয়ে থাকে সেগুলি হচ্ছে আইনগত উৎস। কিন্তু যেগুলি আইন কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে নাই বা আদালত কর্তৃক প্রয়োগের ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নাই, কিন্তু আইনবিকাশে যেগুলির যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে সেগুলিকে ঐতিহাসিক উৎস বলে।

আইনের আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যে পার্থক্যঃ আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যে নিম্নোক্ত পার্থক্যগুলি বিদ্যমানঃ 

(১) আইনগত উৎস আইন দ্বারা স্বীকৃত, কিন্তু ঐতিহাসিক উৎসগুলির সেরূপ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নাই।

(২) আইনগত উৎসগুলি কর্তৃত্বমূলক, প্রমাণিত ও বিশ্বাসযোগ্য। আদালতে এগুলি স্বীয় অধিকারে প্রয়োগ হয়ে থাকে এবং এগুলি বাধ্যতামূলক। অপরপক্ষে, ঐতিহাসিক উৎসগুলি কর্তৃত্বমূলক ও প্রমাণিক নয়। স্বীয় অধিকারে এগুলি আদালত কর্তৃক প্রয়োগ হয় না, এগুলির কেবল প্রেরণামূলক ও নৈতিক ক্ষমতা থাকতে পারে— কিন্তু কর্তৃত্বের সহিত কোন বিধি নির্দেশ করতে পারে না।

(৩) আইনগত উৎসগুলির মাধ্যমেই নতুন বিধিসমূহ গৃহীত হতে পারে। আইনগত স্বীকৃতি লাভের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করলেই এগুলি আইনতঃ স্বীকৃতি লাভ করে। অপরপক্ষে, ঐতিহাসিক উৎসগুলি কেবল পরোক্ষভাবেই কাজ করে। এগুলির বক্তব্য বিভিন্ন বিধিসমূহের মধ্যে প্রতিফলিত হতে পারে এবং প্রকৃতপক্ষে তা-ই হয়। কিন্তু এগুলির কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা নাই।

(৪) আইনগত উৎসের মাধ্যমে সৃষ্ট আইনগুলি আপনিতেই আইন হিসেবে বলবৎ হয এবং আদালত সেগুলি মেনে চলতে বাধ্য থাকে। কিন্তু ঐতিহাসিক উৎসের মাধ্যমে সৃষ্ট আইনগুলির কেবল উপদেশমূলক এখতিয়ার আছে। আদালত সেগুলি গ্রহণ করতে পারে আবার প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

(৫) সকল আইনগত উৎসেরই ঐতিহাসিক উৎস রয়েছে, তথ্য ও ইতিহাসের দিক দিয়ে এগুলির কোন না কোন উৎপত্তিস্থল আছে। কিন্তু সকল ঐতিহাসিক উৎসের আইনগত উৎস নাই।

(৬) বিচার বিভাগীয় পূর্ব সিদ্ধান্ত বা নজীর ক্ষেত্র বিশেষে আইনগত উৎস হতে পারে বা ঐতিহাসিক উৎস হতে পারে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত এদেশের জন্য একটা আইনগত উৎস কিন্তু ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত এদেশের জন্য আইনগত উৎস নয়, একটা ঐতিহাসিক উৎস হিসেবে গণ্য হতে পারে।

মূল্যায়নঃ আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যকার পার্থক্য প্রকৃত অর্থে শুধু তত্ত্বীয় ব্যাপার মাত্র। প্রতিটি আইনগত উৎসের ভিত্তি ঐতিহাসিক উৎসের উপর গ্রথিত দেশের বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে আইনগত উৎস হিসেবে সেদেশের আদালত তা বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় আদালত কোন বিদেশী আদালতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকতে পারেন কিংবা কোন আইনবিশারদের গ্রন্থ হতে সংগ্রহ করতে পারেন যা ঐতিহাসিক উৎস হিসেবে পরিগণিত। একটি নতুন “ আইন প্রণয়নের সময় বিভিন্ন দেশের আইন, প্রখ্যাত আইন গ্রন্থাবলী এবং বিভিন্ন আদালতের মতামত বিবেচনা করা হয়। এগুলি সবই ঐতিহাসিক উৎস, কিন্তু প্রণীত আইন হচ্ছে আইনগত উৎস। আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও একটি অপরটি হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নয়; বরং একটি অপরটির সম্পুরক। এদের মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করা হয় আইনের বৈধতা বিচার করার জন্য, আইনের প্রকৃতি নির্ণয় করার জন্য নয়। আইনের কার্যকারিতা ও প্রয়োগযোগ্যতা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, আইনগত উৎসই সর্বক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আইনের সমৃদ্ধি ও সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক উৎসগুলিই প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক