কাঠামো কার্যগত তত্ত্বের আলোকে ইনপুট-আউটপুট কার্যাবলি ব্যাখ্যা কর


প্রশ্ন : কাঠামো কার্যগত তত্ত্বের আলোকে ইনপুট-আউটপুট কার্যাবলি ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকা: তুলনামূলক রাজনীতি বিশ্লেষণে কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ তত্ত্ব একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোন কার্য কোন কাঠামোর দ্বারা সম্পাদিত হয় তার ভিত্তিতে রাজনীতি ব্যাখ্যা করে এবং তুলনামূলক অধ্যয়নের চেষ্টা করে। এছাড়াও, এ তত্ত্বের সাহায্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইনপুট ও আউটপুট কার্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

ইনপুট ও আউটপুট কার্যাবলি: অধ্যাপক অ্যালমন্ড তাঁর সুপ্রসিদ্ধ The Politics of Developing Areas নামক গ্রন্থে কাঠামো কার্যগত পদ্ধতির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, গতানুগতিক পদ্ধতির তুলনায় এ পদ্ধতি রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণে বেশি উপযোগী। এ পদ্ধতিতে তিনি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যাবলিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, যথা:
১. ইনপুট কার্যাবলি এবং
২. আউটপুট কার্যাবলি।

নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

১. ইনপুট কার্যাবলি: অধ্যাপক অ্যালমন্ড রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইনপুট কার্যাবলিকে মোট চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। নিম্নে ছকের মাধ্যমে দেখানো হল:


নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

১. রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ ও লোক নিয়োগ (Political socialization and recruitment): প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দীক্ষাদান ও লোক সংগ্রহের পদ্ধতি বিদ্যমান থাকে। রাজনৈতিক দীক্ষাদান বলতে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর পদ্ধতিকে বুঝায়। দীক্ষাদানের মাধ্যমে জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন প্রকার সংঘ, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি ব্যক্তিকে বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক দীক্ষা গ্রহণে সাহায্য করে। রাজনৈতিক দীক্ষার কাজ সেখানেই শেষ হয়, যেখান থেকেই লোক সংগ্রহের কাজ শুরু হয়।

অ্যালমন্ড ও পাওয়েল বলেছেন, "We use the term political recruitment to refer to the function by means of which the roles of political systems are filled."
কোন ব্যবস্থার ভূমিকাগুলো পরিচালনার ও কাঠামোর কার্যসম্পাদনের জন্য লোক নিয়োগ অত্যাবশ্যক। লোক নিয়োগের জন্য নীতির প্রয়োজন। সাধারণত উন্নত সমাজে অর্জননীতির উপর ভিত্তি করে এবং উন্নয়নশীল সমাজে আরোপণ নীতির ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করা হয়। লোক নিয়োগের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনা করা যেতে পারে।

২. স্বার্থ উত্থাপন (Interest articulation): অ্যালমন্ড ও পাওয়েল স্বার্থ জ্ঞাপন প্রসঙ্গে বলেছেন, "The process by which individuals and groups make demands upon the political decision makers. We call interest articulation."
স্বার্থ জ্ঞাপন রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ স্বার্থ জ্ঞাপন রাজনৈতিক দীক্ষাদান ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বার্থ জ্ঞাপনে চার ধরনের কাঠামো বিদ্যমান থাকে, যথা:
ক. প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থবাদী গ্রুপ (Institutional interest groups)
খ. সংঘবদ্ধ স্বার্থবাদী গ্রুপ (Associational interest groups)
গ. অসংঘবদ্ধ স্বার্থবাদী গ্রুপ (Non-associational interest groups)
ঘ. তাৎক্ষণিক গ্রুপ (Anomic groups)

ক. প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থবাদী গ্রুপ: এ ধরনের গ্রুপ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত, যারা নিজেদের স্বার্থ জ্ঞাপন ছাড়াও অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনে কর্মরত থাকে এবং কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্য সম্পাদনে অংশগ্রহণ করে। এই গ্রুপ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকারের সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক দল, আইনসভা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও সেনাবাহিনী এ ধরনের গ্রুপের অন্তর্গত।

খ. সংঘবদ্ধ স্বার্থবাদী গ্রুপ: এ ধরনের গ্রুপের নির্দিষ্ট নীতিমালা, কার্যপদ্ধতি, সংবিধান ও বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন রয়েছে। এরা বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ একত্রিত করে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও আইনসভার নিকট প্রেরণ করে। ট্রেড ইউনিয়ন, ব্যবসায় সংগঠন, ধর্ম বা বর্ণভিত্তিক সংঘসমূহ এ ধরনের গ্রুপের অন্তর্গত।

গ. অসংঘবদ্ধ স্বার্থবাদী গ্রুপ: এ ধরনের গ্রুপের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অত্যন্ত অনিয়মিত, অনির্দিষ্ট ও সুপ্ত। এ ধরনের গ্রুপে ব্যক্তিগত প্রভাব ও চাপই কার্যকর থাকে। উদাহরণ: উপজাতি ও আঞ্চলিক সংস্থাসমূহ।

ঘ. তাৎক্ষণিক গ্রুপ: এ ধরনের গ্রুপ কোনো বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাবাবেগের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে গঠিত হয়। অনেক সময় ঝড়ের মতো দ্রুত কিছুক্ষণ বা কয়েকদিন কার্যকর থাকে, পরে নিজেই মিলিয়ে যায়। উদাহরণ: দাঙ্গা, হাঙ্গামা, জনতার উত্তেজিত আন্দোলন।

উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বার্থ জ্ঞাপন সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক ও সংঘবদ্ধ গ্রুপের মাধ্যমে হয়, আর উন্নয়নশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অসংঘবদ্ধ ও তাৎক্ষণিক গ্রুপগুলো এই কাজ সম্পাদন করে।

৩. স্বার্থ একত্রীকরণ (Interest aggregation): স্বার্থকামী গ্রুপগুলোর দ্বারা উত্থাপিত দাবি ও স্বার্থ একত্রিত করা আবশ্যক। এটি সাধারণত সরকারি নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে বা বিশেষ নীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। আইনসভা, নির্বাহি বিভাগ ও প্রশাসন স্বার্থ একত্রীকরণের কাজে নিয়োজিত থাকে। আধুনিক দলীয় ব্যবস্থায় এই কাজে রাজনৈতিক দলই প্রধান ভূমিকা পালন করে।

৪. রাজনৈতিক যোগাযোগ (Political communication): রাজনৈতিক ব্যবস্থার সকল কার্যই রাজনৈতিক যোগাযোগের সাফল্যের উপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক যোগাযোগ বলতে রাজনৈতিক সংলাপ, আলোচনা, আদেশ, নিষেধ ও প্ররোচনা বোঝায়। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ, লোক নিয়োগ, স্বার্থ জ্ঞাপন, স্বার্থ একত্রীকরণ ও আইন প্রণয়ন প্রভৃতি কার্য যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। অ্যালমন্ড চারটি মানদণ্ড ব্যবহার করেছেন:
ক. রাজনৈতিক তথ্যের সমজাতীয়তা
খ. তথ্যের গতিশীলতা
গ. তথ্যের আকার
ঘ. তথ্য প্রবাহের গতি

আউটপুট কার্যাবলি: অ্যালমন্ডের মতে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মোট তিন ধরনের আউটপুট কার্যাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে:


১. বিধি প্রণয়ন (Rule making): স্বার্থ জ্ঞাপন ও দাবি উত্থাপনের আলোকে বিধি প্রণয়ন হয়ে থাকে। এটি ‘ইনপুট’ কাজের একটি ‘আউটপুট’। দেশভেদে ও সরকারের শ্রেণীভেদে বিধি প্রণয়ন ক্ষমতা বিভিন্ন রকম। কোনো কোনো জায়গায় নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। অ্যালমন্ড বিধি প্রণয়নকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন:

ক. উদ্যোগ গ্রহণ (Initiation)
খ. পরিবর্তনকরণ (Modification)
গ. ভেটো প্রদান (Vetoing)
সাধারণত বিধি প্রণয়নের কাজটি আইনসভা করে থাকে।

২. বিধি বাস্তবায়ন (Rule application): বিধি প্রণয়নের পর বাস্তবক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাধারণত নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসন এটি সম্পাদন করে। প্রশাসন প্রণীত আইনের পাশাপাশি নতুন বিধিও যোগ করে।

৩. বিচারকার্য সম্পাদন (Rule adjudication): বিচারকার্য সমাজে কোনো কলহ মীমাংসার ক্ষেত্রে কর্তৃত্বমূলক সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রণীত বিধি কেউ লঙ্ঘন করেছে কি না, লঙ্ঘনের মাত্রা ও শাস্তি নির্ধারণের দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপর। বিচার বিভাগ সামান্য পরিমাণে বিধি বাস্তবায়নও করে। বিচার বিভাগের দক্ষতা, স্বায়ত্তশাসন, কাঠামোগত পৃথকীকরণ ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যবস্থার মধ্যে তুলনা করা যায়।

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানে ব্যবহৃত কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব রাজনীতি বিশ্লেষণেও ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তত্ত্বগত গুরুত্ব অপরিসীম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর গবেষণার পাশাপাশি ব্যাপক সংখ্যক গবেষণায় এ তত্ত্ব তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও এ তত্ত্ব বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন এবং এর সীমাবদ্ধতাগুলো জটিল, তবুও সমকালীন তত্ত্বগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম, যা রাজনীতির নতুন দিক উন্মোচনে সাহায্য করেছে। তুলনামূলক রাজনীতি বিশ্লেষণে এ তত্ত্ব বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক