প্রশ্ন : কাঠামো কার্যগত তত্ত্বের আলোকে ইনপুট-আউটপুট কার্যাবলি ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকা: তুলনামূলক রাজনীতি বিশ্লেষণে কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ তত্ত্ব একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোন কার্য কোন কাঠামোর দ্বারা সম্পাদিত হয় তার ভিত্তিতে রাজনীতি ব্যাখ্যা করে এবং তুলনামূলক অধ্যয়নের চেষ্টা করে। এছাড়াও, এ তত্ত্বের সাহায্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইনপুট ও আউটপুট কার্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
১. ইনপুট কার্যাবলি: অধ্যাপক অ্যালমন্ড রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইনপুট কার্যাবলিকে মোট চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। নিম্নে ছকের মাধ্যমে দেখানো হল:
নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
১. রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ ও লোক নিয়োগ (Political socialization and recruitment): প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দীক্ষাদান ও লোক সংগ্রহের পদ্ধতি বিদ্যমান থাকে। রাজনৈতিক দীক্ষাদান বলতে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর পদ্ধতিকে বুঝায়। দীক্ষাদানের মাধ্যমে জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন প্রকার সংঘ, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি ব্যক্তিকে বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক দীক্ষা গ্রহণে সাহায্য করে। রাজনৈতিক দীক্ষার কাজ সেখানেই শেষ হয়, যেখান থেকেই লোক সংগ্রহের কাজ শুরু হয়।
ক. প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থবাদী গ্রুপ: এ ধরনের গ্রুপ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত, যারা নিজেদের স্বার্থ জ্ঞাপন ছাড়াও অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনে কর্মরত থাকে এবং কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্য সম্পাদনে অংশগ্রহণ করে। এই গ্রুপ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকারের সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক দল, আইনসভা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও সেনাবাহিনী এ ধরনের গ্রুপের অন্তর্গত।
খ. সংঘবদ্ধ স্বার্থবাদী গ্রুপ: এ ধরনের গ্রুপের নির্দিষ্ট নীতিমালা, কার্যপদ্ধতি, সংবিধান ও বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন রয়েছে। এরা বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ একত্রিত করে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও আইনসভার নিকট প্রেরণ করে। ট্রেড ইউনিয়ন, ব্যবসায় সংগঠন, ধর্ম বা বর্ণভিত্তিক সংঘসমূহ এ ধরনের গ্রুপের অন্তর্গত।
গ. অসংঘবদ্ধ স্বার্থবাদী গ্রুপ: এ ধরনের গ্রুপের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অত্যন্ত অনিয়মিত, অনির্দিষ্ট ও সুপ্ত। এ ধরনের গ্রুপে ব্যক্তিগত প্রভাব ও চাপই কার্যকর থাকে। উদাহরণ: উপজাতি ও আঞ্চলিক সংস্থাসমূহ।
ঘ. তাৎক্ষণিক গ্রুপ: এ ধরনের গ্রুপ কোনো বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাবাবেগের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে গঠিত হয়। অনেক সময় ঝড়ের মতো দ্রুত কিছুক্ষণ বা কয়েকদিন কার্যকর থাকে, পরে নিজেই মিলিয়ে যায়। উদাহরণ: দাঙ্গা, হাঙ্গামা, জনতার উত্তেজিত আন্দোলন।
উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বার্থ জ্ঞাপন সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক ও সংঘবদ্ধ গ্রুপের মাধ্যমে হয়, আর উন্নয়নশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অসংঘবদ্ধ ও তাৎক্ষণিক গ্রুপগুলো এই কাজ সম্পাদন করে।
৩. স্বার্থ একত্রীকরণ (Interest aggregation): স্বার্থকামী গ্রুপগুলোর দ্বারা উত্থাপিত দাবি ও স্বার্থ একত্রিত করা আবশ্যক। এটি সাধারণত সরকারি নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে বা বিশেষ নীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। আইনসভা, নির্বাহি বিভাগ ও প্রশাসন স্বার্থ একত্রীকরণের কাজে নিয়োজিত থাকে। আধুনিক দলীয় ব্যবস্থায় এই কাজে রাজনৈতিক দলই প্রধান ভূমিকা পালন করে।
আউটপুট কার্যাবলি: অ্যালমন্ডের মতে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মোট তিন ধরনের আউটপুট কার্যাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে:
১. বিধি প্রণয়ন (Rule making): স্বার্থ জ্ঞাপন ও দাবি উত্থাপনের আলোকে বিধি প্রণয়ন হয়ে থাকে। এটি ‘ইনপুট’ কাজের একটি ‘আউটপুট’। দেশভেদে ও সরকারের শ্রেণীভেদে বিধি প্রণয়ন ক্ষমতা বিভিন্ন রকম। কোনো কোনো জায়গায় নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। অ্যালমন্ড বিধি প্রণয়নকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন:
২. বিধি বাস্তবায়ন (Rule application): বিধি প্রণয়নের পর বাস্তবক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাধারণত নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসন এটি সম্পাদন করে। প্রশাসন প্রণীত আইনের পাশাপাশি নতুন বিধিও যোগ করে।
৩. বিচারকার্য সম্পাদন (Rule adjudication): বিচারকার্য সমাজে কোনো কলহ মীমাংসার ক্ষেত্রে কর্তৃত্বমূলক সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রণীত বিধি কেউ লঙ্ঘন করেছে কি না, লঙ্ঘনের মাত্রা ও শাস্তি নির্ধারণের দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপর। বিচার বিভাগ সামান্য পরিমাণে বিধি বাস্তবায়নও করে। বিচার বিভাগের দক্ষতা, স্বায়ত্তশাসন, কাঠামোগত পৃথকীকরণ ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যবস্থার মধ্যে তুলনা করা যায়।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানে ব্যবহৃত কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব রাজনীতি বিশ্লেষণেও ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তত্ত্বগত গুরুত্ব অপরিসীম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর গবেষণার পাশাপাশি ব্যাপক সংখ্যক গবেষণায় এ তত্ত্ব তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও এ তত্ত্ব বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন এবং এর সীমাবদ্ধতাগুলো জটিল, তবুও সমকালীন তত্ত্বগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম, যা রাজনীতির নতুন দিক উন্মোচনে সাহায্য করেছে। তুলনামূলক রাজনীতি বিশ্লেষণে এ তত্ত্ব বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়।
0 মন্তব্যসমূহ