আচরণবাদকে একটি প্রতিবাদী আন্দোলন বলার কারণ আলোচনা কর


প্রশ্ন: আচরণবাদকে একটি প্রতিবাদী আন্দোলন বলার কারণ আলোচনা কর।

ভূমিকা: তুলনামূলক রাজনীতি বিশ্লেষণে আধুনিক পদ্ধতিসমূহের মধ্যে আচরণবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি অধ্যয়নে রাজনৈতিক কাঠামোর চেয়ে মানুষের আচরণের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করায় আচরণবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সনাতন পদ্ধতির বিরুদ্ধে একটি আন্দোলনরূপে। সনাতন পদ্ধতির বর্ণনামূলক বিশ্লেষণের তুলনায় আচরণবাদের পরীক্ষালব্ধ বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ অধিক গ্রহণযোগ্য ও যুগোপযোগী। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে এ তত্ত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণ্ডি অতিক্রম করে ইউরোপ ও এশিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের প্রভাবিত করে। পরবর্তীতে এটি বিশ্বব্যাপী রাজনীতি বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয় পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। মূলত সনাতন পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবেই এ তত্ত্বের যাত্রা শুরু, তাই একে “প্রতিবাদী আন্দোলন” বলা হয়।

আচরণবাদ: আচরণবাদ হলো মানুষের আচরণকে পর্যালোচনার মাধ্যমে রাজনীতিকে সঠিকভাবে ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস। পরীক্ষালব্ধ ও প্রয়োগযোগ্য তত্ত্ব উদ্ভাবন, নীতিসিদ্ধ বিশ্লেষণ এবং তাদের সত্যাসত্য যাচাইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্যাটার্নের একটি সুসমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুসন্ধানই আচরণবাদের মূল উদ্দেশ্য।

এ প্রসঙ্গে জেমস চার্লস ওয়ার্থ তাঁর Contemporary Analysis of Political Behaviour গ্রন্থে বলেছেন:
“আচরণবাদ কেবল ব্যক্তির কার্যাবলির সাথে জড়িত নয়; এটি তার আচরণজনিত, অনুভূতিজনিত এবং মূল্যায়নমূলক প্রক্রিয়ার সাথেও জড়িত।”

আচরণবাদকে প্রতিবাদী আন্দোলন বলার কারণ: সনাতন বর্ণনামূলক, প্রাতিষ্ঠানিক, অবৈজ্ঞানিক ও নীতিবাচক পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই আচরণবাদের আবির্ভাব ঘটে। প্রখ্যাত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট ডাল এ পদ্ধতিকে একটি “প্রতিবাদী আন্দোলন” হিসেবে অভিহিত করেছেন। এর কারণগুলো হলো—

১. মানব আচরণ বিশ্লেষণ: রাজনীতি বিশ্লেষণে প্রথমবারের মতো মানুষকে একক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মানুষের আচরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা হয়। প্রচলিত কাঠামো ভেঙে নতুন কাঠামো প্রণয়নের জন্য এ ধারা প্রতিবাদী রূপ ধারণ করে।

২. বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা: আচরণবাদের লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক আচরণকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বিশ্লেষণ করা। এজন্য এটি পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতি বিশ্লেষণে প্রয়োগ করে।

৩. তাত্ত্বিক ও নীতিবাদী বিশ্লেষণ বর্জন: আচরণবাদ রাজনীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণকে মূল বিষয়বস্তু করে, আর বিভিন্ন আদর্শ বা কল্পনাধর্মী তত্ত্বকে বর্জন করে। ফলে এটি সনাতন পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধারা তৈরি করে।

৪. সমন্বয় সাধন: আচরণবাদীরা গবেষণায় পরিমাপ ও সংখ্যায়নের মাধ্যমে তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। তারা মূল্যবোধভিত্তিক ধ্যানধারণাকে পরিহার করে, যা পূর্ববর্তী ধারার সরাসরি প্রতিবাদ।

৫. আন্তঃসমাজবিজ্ঞান কেন্দ্রিকতা: আচরণবাদ আন্তঃসমাজবিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার পক্ষে। এটি ব্যক্তির রাজনৈতিক আচরণকে তার সামগ্রিক আচরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, যা পুরোনো প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে।

৬. বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতি: সনাতন পদ্ধতির অবৈজ্ঞানিক ধারা পরিবর্তন করে আচরণবাদ রাজনীতি বিশ্লেষণে পরীক্ষাযোগ্য প্রকল্প, কার্যকর সংজ্ঞা নির্ধারণ ও সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির ব্যবহার করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, আচরণবাদকে প্রতিবাদী আন্দোলন বলা হয়েছে কারণ এটি সনাতন পদ্ধতির বর্ণনামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক ধারা ভেঙে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা, মানব আচরণ বিশ্লেষণ, সমন্বয় সাধন ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আচরণবাদ আধুনিক রাজনীতি অধ্যয়নে একটি যুগান্তকারী ও যুগোপযোগী ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক