সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমস্যাবলি ও তা সমাধানের উপায়সমূহ বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ 
সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমস্যাবলি কি কি? সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ মানুষের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রাষ্ট্র বা সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তিগণকে বৃহত্তর বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হয়, যার উপর একটি সংগঠন, সংস্থা বা একটি জাতি নির্ভরশীল থাকতে পারে। সিদ্ধান্তের উপযুক্ততা, শ্রেষ্ঠত্ব ও কুশলতার উপরও নির্ভর করে অনেকের ভাগ্য। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয় আর কমই আছে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সমাজবিজ্ঞানীদের নিকট এক অন্যতম অধ্যয়নের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। 

সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমস্যাবলি (Problems of Decision Making): প্রত্যেক সিদ্ধান্ত প্রণেতাকেই সঠিক ও যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে কতিপয় জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। নিচে এ সমস্যাগুলো বর্ণনা করা হলোঃ

প্রথমত, মানুষের জীবন সব সময় সুপরিকল্পিতভাবে চলতে পারে না। জীবনে চলার পথে প্রতিনিয়ত নানারূপ ঘাত-প্রতিঘাত, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বাঁধার সৃষ্টি হয়। তাই আজকে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তা ভবিষ্যতের আলোকে পর্যালোচনা করে তার ভালমন্দ মূল্যায়ন করতে হবে। অনেক সিদ্ধান্তই মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিদ্যমান অথবা উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে হয়। তাই খুব কম সংখ্যক সিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সিদ্ধান্ত প্রণেতাকে মনে রাখা উচিত কিভাবে স্বল্পত্যাগের মাধ্যমে বৃহৎ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। 


দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা সিদ্ধান্তের ফলাফলের উপর খুব সামান্যই প্রভাব ফেলতে পারে। সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সব সময়ই ভবিষ্যৎ আচার-আচরণ, পরিস্থিতি নিয়ে বিজড়িত থাকে। কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিশ্চয়তার সাথে জোর গলায় ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই জটিল ব্যাপার। ভবিষ্যতের কোন সমস্যা সমাধান অথবা উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার মানসে মানুষ সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করে থাকে। কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনেকগুলো বিকল্প পন্থা খোলা থাকে । তাই সিদ্ধান্ত প্রণেতার পক্ষে এটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় কোন্ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে সবচেয়ে সহজ ও সাফল্যজনকভাবে ইন্সিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যাবে। তাই এ অবস্থা হতে পরিত্রাণ পেতে হলে সিদ্ধান্ত প্রণেতাকে সর্বপ্রথম বিবেচনা করতে হবে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যে পৌছবার ক্ষেত্রে কি কি সমস্যা দিতে পারে। কতকগুলো উদ্দেশ্যকে সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হয় আবার কতকগুলোকে চিহ্নিত করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। 


তৃতীয়ত, অনেকগুলো বিষয় সিদ্ধান্ত প্রণেতার নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাজ করে, যা সিদ্ধান্তের ফলাফলের উপর খুব প্রভাব ফেলে। এগুলোর পরিপূর্ণ বর্ণনা অথবা সিদ্ধান্তের ফলাফলের উপর যে ধরনের প্রভাব বিস্তার করে তার যথার্থ ব্যাখ্যা প্রদান করা অনেকটা অসম্ভব। কদাচিৎ এ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পাওয়া যায়। মানুষের এ অক্ষমতাকে হারবার্ট এ. সাইমন (Herbert A. Simon) তাঁর বিখ্যাত 'Principle of Bounded Rationality' তত্ত্বে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এ তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, খুব সীমিত ক্ষেত্রেই মানুষ সিদ্ধান্ত প্রণয়নজনিত সমস্যায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে মানুষ সম্ভাব্য ফলাফল সম্বন্ধে অনেকগুলো পন্থা বের করতে পারে। 


চতুর্থত, সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অথবা বাইরে থেকে চাপানো মূল্যবোধের সাথে তাল মিলিয়ে চলা একান্ত জরুরি। তাই যে কোন প্রশাসনিক সংস্থাকে গণদাবির প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া চাই। তবে প্রশাসনিক সংস্থা ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে তার অনুকূল মূল্যবোধ অথবা জনসমর্থন সৃষ্টি করতে পারে। 


পঞ্চমত, অনেক অনেক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে নৈতিক বিষয়াবলির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ অথবা বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রায়শই উপেক্ষা করতে হয়। তাই এমন অবস্থায় বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা তা হতে বিরত থাকতে বাধ্য করতে পারে না। 


ষষ্ঠত, সিদ্ধান্ত দ্রুত প্ৰণয়নের সময় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার ব্যবস্থা মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে। অবশ্য বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণের ব্যবস্থা লোক প্রশাসনে একান্ত প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। কতকগুলো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ও গতানুগতিক সুনির্দিষ্ট সহযোগিতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করতে হয়। ফলে অহেতুক বিলম্ব ও অযথা হয়রানি পরিদৃষ্ট হয়। এ পদ্ধতিকে সাধারণত লাল ফিতার দৌরাত্ম্য (Red tapes) বলে অভিহিত করা হয়। 


সপ্তমত, অতি সমন্বয়ী (Over Co-ordination) ব্যবস্থা সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে আর একটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে। জাতিসংঘ প্রকাশিত 'The Hand Book of Public Administration' গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, “সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন নীতি এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এটা সাধারণত একাধিক মন্ত্রণালয়কে প্রভাবিত করে। 


সুতরাং দেখা যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথাপি মানুষ সমস্যার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত না হয়ে বরং পর্যবেক্ষণ ও অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিবেক-বুদ্ধির পরিচয় দিবে –এটাই স্বাভাবিক। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা ভুল-ভ্রান্তি নিরসন করে বিবেকসম্পন্ন সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে আলোকবর্তিকা প্রদর্শন করে থাকে। 


সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ (Methods of Removing the Problems of Decision Making): সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

 

প্রথমত, সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদিও এক জটিল ব্যাপার, তথাপি উপযুক্ত জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্যাবলি বহুলাংশে লাঘব করা সম্ভব। জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যকার বিরাজমান পারস্পরিক সম্পর্ক ও জটিলতা সম্যকভাবে উপলব্ধি করা যায়। 


দ্বিতীয়ত, গাণিতিক ও পরিসংখ্যানবিদগণও অনেকগুলো সিদ্ধান্ত প্রণয়নজনিত সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দিতে সক্ষম। এটা ধরে নেয়া হয় যে, অতীতের ঘটনাবলি ভবিষ্যতের অনুরূপ ঘটনাবলির পথ দেখাতে পারে এবং উদ্ভূত সমস্যার সমাধান দিতে পারে। 


তৃতীয়ত, অতীত অভিজ্ঞতা সমুদয় বস্তুগত সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে প্রশাসকের ভবিষ্যৎ সমস্যাবলি সম্বন্ধে নিজস্ব প্রজ্ঞা ও জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। প্রশাসকের সমস্যা সম্বন্ধে নিজস্ব পরিকল্পনা, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং অন্তর্দৃষ্টি থাকা একান্ত প্রয়োজন। তাই দক্ষ ও বুদ্ধিমান প্রশাসক নিযুক্তির মাধ্যমেও এ সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা যায়। 


চতুর্থত, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণের মাধ্যমেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়। ফ্রেডারিক ডব্লিউ, টেলর (Frederick W. Taylor) বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। 


পঞ্চমত, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক বা প্রযুক্তিগত গবেষণা সমস্যা সমাধানে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। পূর্বতন বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা অপেক্ষা প্রায়োগিক গবেষণা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিল ও পরিবর্তনশীল সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত প্রণেতাকে বাস্তব গাণিতিক যোগ্যতা প্রদান করে। ফলে সমস্যার জটিলতা হতে পরিত্রাণ পাওয়া সহজসাধ্য হয়ে উঠে।


সমাপনীঃ রাষ্ট্রীয় বা জাতিগতভাবে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যারা বিশ্বের মানব সম্প্রদায় বিষয়টির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। কারণ যুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রকম জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নির্ভুল ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরো অনেক বেশি অনুভূত হয়ে চলেছে। তাই হার্বার্ট সাইমন (Herbert Simon) সিদ্ধান্ত গ্রহণকে 'Heart of Administration' বলে অভিহিত করেছেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক