নেতৃত্ব কাকে বলে?


প্রশ্নঃ নেতৃত্ব কাকে বলে? 

ভূমিকাঃ নেতৃত্ব কোন সাধারণ ধারণার নাম নয় বরং একটি জটিল ধারণার নাম। স্থান-কাল-পাত্র ও পরিবেশ পরিস্থিতির বিচারে নেতৃত্বের ধারণা ভিন্নতর। লোক প্রশাসনে আলোচ্য নেতৃত্ব বিশেষত প্রশাসনিক নেতৃত্ব। ফলে ছোট বড় সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। এ নেতৃত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে কীথ ডেভিস (Keith Davis) তার রচিত 'Human Relations at Work' গ্রন্থে বলেন, “নেতৃত্বহীন সংগঠন মানুষ ও যন্ত্রের এক বিশৃঙ্খল সমাবেশ মাত্র। গোষ্ঠীভুক্ত সদস্যদেরকে লক্ষ্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করার যোগ্যতাই হচ্ছে নেতৃত্ব। গোষ্ঠীকে একত্রিত করার জন্য এটা একটি মানবিক উপাদান। উপাদানটি লক্ষ্য অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। নেতৃত্ব সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে এবং বিশেষ করে সংগঠন ও এর সদস্যদের সুপ্ত সম্ভাবনাকে সফলতায় রূপ দেয়ার চরম দায়িত্ব বহন করে।”

নেতৃত্ব ব্যতীত কোন প্রতিষ্ঠানই পরিচালিত হতে পারে না। যেমনঃ সরকারি সচিবালয় বা অফিসসমূহ, সংস্থা, কমিশন, বোর্ড, জনসংস্থা, মিল, কারবারি প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব অপরিহার্য উপাদান হিসেবে কাজ করে। এভাবে সকল প্রতিষ্ঠানের যত কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন নির্ভর করে সুযোগ্য নেতৃত্বের উপর। অতএব নেতৃত্বহীনতা বা দুর্বল নেতৃত্ব উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য এক মারাত্মক সমস্যা। একবিংশ শতাব্দীর এ সর্বোৎকৃষ্ট কলাকৌশলের অগ্রগতির যুগে সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রতিটা পদক্ষেপে উন্নত ও যুগোপযোগী নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। ক্ষুদ্র বা বৃহৎ সর্ব প্রকার সংস্থা ও সংগঠনেই এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য।

নেতৃত্বের সংজ্ঞা (Definition of Leadership): রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসন বিষয়ক গবেষকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিতে ‘নেতৃত্ব’কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং এর ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তাদের ধারণা, মতামত ও বর্ণনার মধ্যে মিল এবং অমিল উভয় সুস্পষ্ট; সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে নিচে আমরা নেতৃত্বের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করবঃ

(ক) সাধারণ সংজ্ঞাঃ সাধারণ অর্থে নেতা একজন ব্যক্তি, যিনি কোন এক বা একাধিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণকে একত্রিত করে তাদের পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, নেতৃত্ব গড়ে উঠে কেবল একজন ব্যক্তির আচরণ, ব্যক্তিত্বসহ অন্যান্য গুণাবলিকে ঘিরে। কিন্তু ব্যক্তির আচরণ যদিও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথাপি এটাই নেতৃত্ব গঠনের জন্য যথেষ্ট নয়। নেতাকে যারা অনুসরণ করবে সেই অনুগামীদের চরিত্র, গুণাবলিও নেতৃত্ব বিকাশের জন্য যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে থাকে। নেতৃত্ব একটি সামাজিক প্রক্রিয়া এবং গোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। বর্তমান সভ্যতা সামাজিক একক তথা সংগঠনের উপর নির্ভরশীল। আর এর উদ্দেশ্য হলো কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন। নেতা এ গোষ্ঠী বা সংগঠনেরই একটি অন্যতম অংশ, যদিও তার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্যবোধ। তিনি এ গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য অর্জনে সমবেত ও সাহায্য করেন, অথচ স্বকীয়তা ও স্বঅস্তিত্বকে অটুট রাখেন। অর্থাৎ সংগঠন বা গোষ্ঠীভুক্ত অন্যতম সদস্যের দ্বারা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সুষ্ঠু পরিচালনা ও দিকনির্দেশনা প্রাপ্তির আশ্রয়স্থলকে নেতৃত্ব বলা যায়।

(খ) প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন প্রশাসন বিজ্ঞানী, এ বিষয়ের লেখক, গবেষক ও পণ্ডিত ব্যক্তি নেতৃত্বের যে সকল সংজ্ঞা প্রদান করেছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞাগুলো নিচে আলোচনা করা হলোঃ 

সে সেকলার হাডসন (Seckler Hadson) নেতৃত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন যে, "Leadership in large organizations monk be defined as influencing and encouraging people to work together in a common effort to achieve the purpose of the enterprise." অর্থাৎ বৃহদায়তন সংগঠনের নেতৃত্ব বলতে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সাধনের উদ্দেশ্যে কোন সাধারণ কর্মপ্রচেষ্টায় সমবেতভাবে কর্ম সম্পাদন করতে মানুষকে প্রভাবিত এবং উৎসাহিত করাকেই বুঝায়। 

এইচ. কুন্টজ, এবং ও ডনিয়েল ( H. Koontz, & 0. Donnell) বলেন, "Leadership is the activity of persuading people to co-operative in the achievement of a common objective." অর্থাৎ এটি (নেতৃত্ব) সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য জনগণকে সহযোগী হতে প্ররোচিত করার কাজ। 

চেস্টার আই. বার্নার্ড (Chester I. Barnard) লিখেছেন যে, "It ( Leadership) refers to the quality of the behavior's of individuals whereby they guide people of their activities in organized effort." অর্থাৎ এটা (নেতৃত্ব) সেসব ব্যক্তিদের আচরণের গুণ নির্দেশ করে যা দ্বারা সংগঠিত উপায়ে জনগণের কার্যাবলি পরিচালিত করা হয়।

কীথ ডেভিস (Keith Davis) বলেন, “গোষ্ঠীর সদস্যদেরকে লক্ষ্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করার যোগ্যতাই হলো নেতৃত্ব।”

টেরি (Terry) সংজ্ঞা প্রদান করেছেন এভাবে, “ইচ্ছায় পারস্পরিক উদ্দেশ্য অর্জনে জনগণকে প্রভাবান্বিত করার কাজই হচ্ছে নেতৃত্ব।”

জি. আর টেরি ( G. R. Terry)-র মতে, "Leadership is the activity of influencing people to strive willingly for mutual objectives." অর্থাৎ নেতৃত্ব হচ্ছে পারস্পরিক লক্ষ্য অর্জনে স্বেচ্ছায় সংগ্রাম করতে মানুষকে প্রভাবিত করার কার্যকলাপ। 

ওর্ডওয়ে টীড (Ordway Tead) নেতৃত্বের সংজ্ঞায় বলেন, “কর্তৃত্ব আকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য অর্জনে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে জনগণকে অনুপ্রাণিত করার নামই নেতৃত্ব।" 

কারটার (Carter) ভিন্ন আঙ্গিকে নেতৃত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ৫টি পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন। যথাঃ (১) কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠীর সদস্যদের সম্প্রসারণ, (২). গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালনার জন্য একজন ব্যক্তির সামর্থ্য, (৩) গোষ্ঠী কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তিই গোষ্ঠীকে পরিচালিত করে, (৪) গোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট পথে যেন সামাজিকতা অথবা সংহতির দিকে পরিচালিত করার ব্যক্তির দক্ষতা এবং (৫) ব্যক্তির নির্দিষ্ট ধরনের আচরণ।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, ব্যবস্থাপক সংগঠনের সাধারণ অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কার্যাবলি নির্দেশ, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বিত করেন তাকেই নেতৃত্ব বলা হয়৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক