নেতৃত্বের স্বরূপ বা প্রকৃতি আলোচনা কর


প্রশ্নঃ নেতৃত্বের স্বরূপ বা প্রকৃতি আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ নেতৃত্ব কোন সাধারণ ধারণার নাম নয় বরং একটি জটিল ধারণার নাম। স্থান-কাল-পাত্র ও পরিবেশ পরিস্থিতির বিচারে নেতৃত্বের ধারণা ভিন্নতর। লোক প্রশাসনে আলোচ্য নেতৃত্ব বিশেষত প্রশাসনিক নেতৃত্ব। ফলে ছোট বড় সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। এ নেতৃত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে কীথ ডেভিস (Keith Davis) তার রচিত 'Human Relations at Work' গ্রন্থে বলেন, “নেতৃত্বহীন সংগঠন মানুষ ও যন্ত্রের এক বিশৃঙ্খল সমাবেশ মাত্র। গোষ্ঠীভুক্ত সদস্যদেরকে লক্ষ্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করার যোগ্যতাই হচ্ছে নেতৃত্ব। গোষ্ঠীকে একত্রিত করার জন্য এটা একটি মানবিক উপাদান। উপাদানটি লক্ষ্য অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। নেতৃত্ব সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে এবং বিশেষ করে সংগঠন ও এর সদস্যদের সুপ্ত সম্ভাবনাকে সফলতায় রূপ দেয়ার চরম দায়িত্ব বহন করে।”

নেতৃত্বের সংজ্ঞাঃ সাধারণ অর্থে নেতা একজন ব্যক্তি, যিনি কোন এক বা একাধিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণকে একত্রিত করে তাদের পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। সংগঠন বা গোষ্ঠীভুক্ত অন্যতম সদস্যের দ্বারা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সুষ্ঠু পরিচালনা ও দিকনির্দেশনা প্রাপ্তির আশ্রয়স্থলকে নেতৃত্ব বলা যায়।

এইচ. কুন্টজ, এবং ও ডনিয়েল ( H. Koontz, & 0. Donnell) বলেন, "Leadership is the activity of persuading people to co-operative in the achievement of a common objective." অর্থাৎ এটি (নেতৃত্ব) সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য জনগণকে সহযোগী হতে প্ররোচিত করার কাজ। 

চেস্টার আই. বার্নার্ড (Chester I. Barnard) লিখেছেন যে, "It ( Leadership) refers to the quality of the behavior's of individuals whereby they guide people of their activities in organized effort." অর্থাৎ এটা (নেতৃত্ব) সেসব ব্যক্তিদের আচরণের গুণ নির্দেশ করে যা দ্বারা সংগঠিত উপায়ে জনগণের কার্যাবলি পরিচালিত করা হয়।

নেতৃত্বের স্বরূপ বা প্রকৃতি (Nature of Leadership): বিশিষ্ট প্রশাসন গবেষক জন ডি. মিলেট (John D. Millet) বলেন, সরকারি কাজের ব্যবস্থাপনায় প্রথম দায়িত্ব হলো আকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যাবলির দিকে কাজকে পরিচালিত এবং নির্দেশিত করার জন্য নেতৃত্বের সংস্থান করা। ফলশ্রুতিতে বলা চলে নেতৃত্ব হচ্ছে সমষ্টিগত আচরণের এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশক। চেস্টার আই. বার্নার্ড-এর মতে, নেতৃত্ব (১) ব্যক্তি, (২) অনুগামী এবং (৩) অবস্থার উপর নির্ভরশীল। 

আধুনিক ও উন্নত ধরনের উৎপাদন পদ্ধতি কোন প্রতিষ্ঠানের জন্যই যথেষ্ট নয়। শ্রমশক্তিকে উপযুক্তভাবে ব্যবহারের জন্য সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত প্রশাসন-ব্যবস্থার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। আর নেতৃত্বকেই এ গুরুদায়িত্ব বহন করতে হয়। প্রশাসনিক নেতৃত্বকে অধস্তনদের জ্ঞান এবং বিচার ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হয়। কোন একটি দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে কিভাবে কাজ করতে হবে সেটা নির্ভর করে সে দেশের সংগঠনের সমস্যা, প্রশাসন, বিভিন্ন কলাকৌশল এবং যে কর্তৃত্ব এগুলো মোকাবিলা করছে তার উপর।

উন্নতমানের যন্ত্র ও অভিজ্ঞ কর্মচারী প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের পথে যেমন প্রয়োজন, তেমনি পরিচালনার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব একটা বিরাট অংশ। কিন্তু নেতৃত্বের অর্থ এই নয় যে, নিজের ইচ্ছাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেবে। প্রশাসককে গণতান্ত্রিক ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হচ্ছে, ত্যাগ করতে হচ্ছে মধ্যযুগীয় বা আমলাতান্ত্রিক মনোভাব। উৎপাদন বাড়াতে শ্ৰমিক বা কর্মচারীদেরকে নিজের কাজের প্রতি আগ্রহশীল করে তুলতে হচ্ছে। প্রশাসককে রুটিন-বাঁধা কাজে সীমাবদ্ধ থাকলে কিংবা ‘ফাইলের' পর ‘ফাইল' নিয়ে ডুবে থাকলে চলছে না; তাকে নেতৃত্বের ভূমিকায় নেমে আসতে হচ্ছে।

পক্ষান্তরে, অধস্তন কর্মচারীদের মানসিকতারও আমূল পরিবর্তন হয়েছে; প্রশাসনিক সংস্থায় তাদের ভূমিকা যে নগণ্য নয় এ সচেতনতা তাদেরকে একটি প্রগতিশীল ও পরিবর্তনশীল যুগের সন্ধান দিয়েছে। তথাপি প্রশাসনিক সংস্থায় সমস্যা কাটেনি। প্রশাসকের সাথে কর্মচারীদের যুগান্তকারী সম্পর্কের অবতারণার পরেও দেখা যাচ্ছে উভয়ের কাম্য যোগসূত্র স্থাপনে কতকগুলো শর্তপালন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসক এসব শর্ত পালন করতে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনও ব্যর্থ হচ্ছে।

নিম্নস্তরের কর্মচারীরা আপন দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিচার করেন থাকেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং শিক্ষিত। তারা মনে করেন, তারা নিজেরা যা জানেন তার সবটুকু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেরও জানা দরকার। তাছাড়া কর্মচারিদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক জীবনের দ্বন্দ্ব কর্মক্ষেত্রে অসন্তোষ ছড়ায় বা বিরাজমান অসন্তোষের আগুনে ঘৃত সংযোজন করে। তাই এমতাবস্থায় প্রশাসককে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হয়। আর তিনি যদি আদর্শ প্রশাসক হন তবে নিজেকে আদেশ প্রদানকারী নয় বরং প্রতিষ্ঠানের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হন।

নেতৃত্ব মূলত প্রভাব ও ক্ষমতার সাথে সম্পর্কযুক্ত যা সংগঠনের কাঠামোর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই আর. টেনেনবাম এন্ড এফ. মাসারিক (Robert Tennenbum and Fred. Massarick) বলেছেন, “নেতার প্রভাবক (পক্ষে পরিস্থিতি অনুযায়ী এক বা একাধিক অনুগামী কর্তৃক প্রভাবিত) আচরণের উপর ছাপ ফেলার চেষ্টার সাথে নেতৃত্ব সর্বদা, সম্পৃক্ত হয়। অতএব তাদের দৃষ্টিতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পৃথক বিষয়। কিন্তু নেতৃত্বের মূল অংশই হলো ক্ষমতা। নেতৃত্ব মূলত প্রভাব বিস্তারের সাথে সংশ্লিষ্ট।

চরিত্রগত দিক দিয়ে মূলত নেতৃত্বকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে হয়। উৎকৃষ্ট মানের শক্তি, জনগণ, বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা, সংহতি ও নৈতিকতার দ্বারা নেতৃত্ব গুণ অর্জন করা যায়। তবে গবেষণার ফলাফল হলো- কাঠামোর শীর্ষস্থানীয় একক ব্যক্তিত্ব দেখার চেয়ে নেতৃত্ব অনেক গুণ জটিল। পিফনার গবেষণা দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, ক্রমবিন্যাসের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি মূলত নেতা নন; সর্বোচ্চ পদের চেয়ে সংঘের অন্য কোথাও নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা অবস্থান করে। যাদের হাতে কোন সংঘের সামগ্রিক নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা আছে তাদের সাথে নেতৃত্বের সংমিশ্রণ হয়।

উপসংহারঃ মোটকথা, ব্যবস্থাপক সংগঠনের সাধারণ অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কার্যাবলি নির্দেশ, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বিত করেন তাকেই নেতৃত্ব বলা হয়৷  ক্যারাল সার্টেল (Carral Shartle) দেখিয়েছেন যে, নেতৃত্ব বিধি অন্যদের আচরণ বা অভিন্ন লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন দেয়। তাই নেতৃত্বকে অন্যদের কৃতকর্মের দ্বারা পরিমাপ করা হয়। রেনসিস লিকার্ট (Rensis Likert)-ও বলেন যে, “সকলের আচরণ আত্মস্বীকৃতির সর্ব প্ররোচক আকাঙ্ক্ষার দ্বারা প্রভাবিত হয় বলে ধারণা করা যায়।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক