রাজনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে আচরণবাদের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর


প্রশ্নঃ রাজনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে আচরণবাদের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।

ভূমিকা: তুলনামূলক রাজনীতি বিশ্লেষণের ইতিহাসে যে সব পদ্ধতির বিকাশ ঘটেছে, তার মধ্যে আচরণবাদ (Behaviouralism) অন্যতম একটি আধুনিক পদ্ধতি। রাজনীতি বিশ্লেষণে এ পদ্ধতির প্রাথমিক প্রয়োগ দেখা যায় ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে ডেভিড ইস্টন, গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড, রবার্ট ডাল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় এর ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে।

আচরণবাদের মূল লক্ষ্য হলো তত্ত্ব ও গবেষণার পারস্পরিক নির্ভরশীল কাঠামো গড়ে তুলে রাজনীতি অধ্যয়নের সনাতন, ঐতিহাসিক, বর্ণনামূলক ও আইনগত পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা। এ কারণে অনেকেই আচরণবাদকে “সনাতন পদ্ধতির বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন” বলে অভিহিত করেছেন।

আচরণবাদ: আচরণবাদ হলো এমন একটি পদ্ধতি, যা মানুষের পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের মাধ্যমে রাজনীতিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা করে। এটি পরীক্ষালব্ধ ও প্রয়োগযোগ্য তত্ত্ব উদ্ভাবন, রীতিসিদ্ধ বিশ্লেষণ এবং তথ্যের সত্যাসত্য যাচাইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্যাটার্নকে সুসমন্বিতভাবে বিশ্লেষণ করে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আচরণবাদকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা নিম্নরূপঃ

  • নরম্যান ডি. ব্যারি বলেছেন,
    “আচরণবাদ একটি সামাজিক বিশ্লেষণ, যা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ বর্ণনার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের উপর গুরুত্ব দেয়।”
    (A form of social explanation in which observed behaviour is stressed rather than the simple description of institutions.)

  • রবার্ট ডাল মনে করেন,
    “আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে একটি প্রতিবাদ আন্দোলন। এটি ব্যক্তির পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে আধুনিক মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব ও অর্থনীতির তত্ত্ব, পদ্ধতি ও অভিজ্ঞতার সাহায্যে সমৃদ্ধ করতে চায়।”

  • ডেভিড ট্রুম্যান এর মতে,
    “আচরণবাদ বলতে বোঝায় অনুমান সম্পর্কিত একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি, সাক্ষ্য ও প্রমাণের কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ বিন্যাস, অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির উপর গুরুত্ব এবং সংখ্যায়ন।”

  • জেমস চার্লস ওয়ার্থ তাঁর Contemporary Analysis of Political Behaviour গ্রন্থে লিখেছেন,
    “আচরণবাদ কেবল ব্যক্তির কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং এটি তার জ্ঞানগত, অনুভূতিজনিত ও মূল্যায়নমূলক প্রক্রিয়ার সঙ্গেও সম্পর্কিত।”

  • বিল ও হার্ডগ্রেভ এইচ. ইউলা উল্লেখ করেন,
    “আচরণবাদের ভিত্তি দুটি অনুমানের উপর নির্ভরশীল—
    (১) রাজনীতি একটি বিশেষ ধরনের সামাজিক কার্যকলাপ, এবং
    (২) রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে সামাজিক বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।”

পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণ অধ্যয়ন এবং তাতে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োগই আচরণবাদের মূল বৈশিষ্ট্য।

আচরণবাদের প্রকৃতি: রাজনীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আচরণবাদের মূল লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক পছন্দ ও মূল্যবোধনির্ভর ধ্যান–ধারণা পরিহার করে মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করা।

আচরণবাদীরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় গ্রহণ করেন। তারা “উচিত–অনুচিত”, “ভালো–মন্দ”, “ন্যায়–অন্যায়” প্রভৃতি মূল্যবোধকে এড়িয়ে বাস্তব তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণ করেন।

তাদের মতে, রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বোঝার জন্য প্রয়োজন তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়, যেখানে পরিমাপযোগ্য তথ্য ও সংখ্যাগত বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
অতএব, আচরণবাদের প্রকৃতি হলো মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা।

উপসংহার: উপসংহারে বলা যায়, আচরণবাদ রাজনীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পদ্ধতি। এটি ব্যক্তির পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করতে চায় এবং আধুনিক মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব ও অর্থনীতির তত্ত্ব ও পদ্ধতির সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণাকে অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত করে তোলে। রবার্ট ডালের ভাষায়, “আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে অভিজ্ঞতালব্ধ, নিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক রূপে বিকশিত করার এক অবিচল প্রচেষ্টা।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক