রাজনীতি অধ্যয়নের পদ্ধতি হিসেবে আচরণবাদের সমালোচনাসমূহ উল্লেখ কর


প্রশ্ন: রাজনীতি অধ্যয়নের পদ্ধতি হিসেবে আচরণবাদের সমালোচনাসমূহ উল্লেখ কর।

ভূমিকা: আচরণবাদ কয়েকটি মৌলিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এসব ধারণার সমন্বয়ে আচরণবাদের ভিত্তি গঠিত হয়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে আচরণবাদের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন আচরণবাদী দার্শনিকগণ নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আচরণবাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এদের মধ্যে ই. এম. কার্কপ্যাট্রিক, হেনজ ইউলা ও ডেভিড ইস্টন প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আচরণবাদের সংজ্ঞা: আচরণবাদ হলো মানুষের আচরণ পর্যালোচনার মাধ্যমে রাজনীতিকে সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস। পরীক্ষালব্ধ ও প্রয়োগযোগ্য তত্ত্ব উদ্ভাবন, রীতিসিদ্ধ বিশ্লেষণ এবং তাদের সত্যাসত্য যাচাইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্যাটার্নের সুসমন্বিত অনুসন্ধানই আচরণবাদ।

নরম্যান ডি. ব্যারি বলেছেন,

“আচরণবাদ একটি সামাজিক বিশ্লেষণ, যা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ বর্ণনার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।”

ডেভিড ট্রুম্যান এর মতে,

“আচরণবাদ বলতে বুঝায় অনুমান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি, সাক্ষ্য ও প্রমাণের কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ বিন্যাস, অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির উপর গুরুত্ব এবং সংখ্যায়ন।”

জেমস চার্লস ওয়ার্থ তাঁর Contemporary Analysis of Political Behaviour গ্রন্থে লিখেছেন—

“আচরণবাদ কেবল ব্যক্তির কার্যাবলির সঙ্গে জড়িত নয়, এটি তার বোধ, অনুভূতি এবং মূল্যায়নমূলক প্রক্রিয়ার সঙ্গেও সম্পর্কিত।”

পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণ অধ্যয়ন এবং বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োগই আচরণবাদ।

আচরণবাদের সমালোচনাসমূহ:

১. বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির অবহেলা: রাজনীতি বিশ্লেষণের বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। রাজনীতির বর্ণনামূলক আলোচনার মাধ্যমে অতীতের রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে জানা যায় এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থাও অনুধাবন করা সম্ভব হয়। কিন্তু আচরণবাদীরা রাজনীতির এ ধরনের বর্ণনামূলক বিশ্লেষণকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছেন।

২. প্রাথমিক অনুমানকে চূড়ান্ত বিবেচনা: আচরণবাদীরা গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে সংগৃহীত তত্ত্ব ও অনুমানকে অনেক সময় চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু এভাবে রাজনীতির প্রকৃত ও গভীর বিশ্লেষণ সম্ভব নয়।

৩. ঐকমত্যের অভাব: রাজনৈতিক আচরণকে বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করলেও আচরণবাদীরা রাজনীতির সংজ্ঞা নির্ধারণে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে রাজনীতির একটি একক ও সুস্পষ্ট ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

৪. সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করা কঠিন: রাজনীতি একটি গতিশীল ও পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। তাই এর ঘটনাবলি পরীক্ষামূলকভাবে যাচাই করা কঠিন। আচরণবাদীরা পরীক্ষামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাধারণ সূত্র আবিষ্কারে ব্যর্থ হন।

৫. ‘খাঁটি বিজ্ঞান’-এর ধারণা সঠিক নয়: আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘খাঁটি বিজ্ঞান’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন, কিন্তু প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞানের সেই মানদণ্ড পূরণ করে না। এটি সামাজিক বিজ্ঞান, যার মধ্যে মানবিক উপাদান প্রবলভাবে বিদ্যমান।

৬. রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট: আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, গণিত ও পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিশিয়ে এর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করেছেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলাদা একাডেমিক পরিচয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

৭. মূল্যবোধ নিরপেক্ষতার অতিরিক্ত গুরুত্ব: মূল্যবোধ একটি জাতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু আচরণবাদীরা রাজনীতি বিশ্লেষণে মূল্যবোধ নিরপেক্ষতার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক জীবনে নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষয় ঘটিয়েছেন।

৮. বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা অযৌক্তিক: অনেকেই আচরণবাদকে সমাজবিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কৌশল রাজনীতি বিশ্লেষণে প্রয়োগের কারণে ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বাস্তবে আচরণবাদ রাজনীতিতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। তাই একে বিপ্লব বলা সঙ্গত নয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে বলা যায়, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও রাজনীতি বিশ্লেষণে আচরণবাদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এটি সনাতন পদ্ধতির বিরোধিতা করে আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে। যদিও আচরণবাদ সর্বক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করেনি, তবুও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার ক্ষেত্রে এর অবদান অনস্বীকার্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক