মানচিত্র অভিক্ষেপের শ্রেণীবিভাগ বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ মানচিত্র অভিক্ষেপের শ্রেণীবিভাগ বর্ণনা কর।
প্রশ্নঃ মানচিত্র অভিক্ষেপের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগের ছকটি লিখ।

ভূমিকা: পৃথিবী গোলাকার হওয়ায় তার সমগ্র পৃষ্ঠ বা অংশবিশেষ কাগজে অঙ্কন করা সহজ নয়। এজন্য ভূগোলের তথ্যসমূহকে গাণিতিক পদ্ধতিতে সমতল কাগজে প্রকাশ করার কৌশলকেই মানচিত্র অভিক্ষেপ বলা হয়। তবে মনে রাখতে হবে, কোনো মানচিত্র অভিক্ষেপই সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়। প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের অভিক্ষেপ ব্যবহার করা হয়।

মানচিত্র অভিক্ষেপ: সমগ্র পৃথিবী বা পৃথিবীর অংশবিশেষ কিংবা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে মানচিত্র আঁকার জন্য একই অভিক্ষেপ সর্বত্র ব্যবহার করা যায় না। কারণ, একই অভিক্ষেপে পৃথিবীর সব অঞ্চল ও সব উদ্দেশ্যের মানচিত্র সঠিকভাবে অঙ্কন করা সম্ভব নয়। এ কারণে বিভিন্ন প্রকার মানচিত্র অভিক্ষেপের উদ্ভাবন হয়েছে।

কাঁচ, প্লাস্টিক বা অনুরূপ কোনো স্বচ্ছ পদার্থ দ্বারা সৃষ্ট ভূগোলকের মধ্যে দিয়ে আলোক প্রক্ষেপ করলে ভূগোলকের অক্ষ ও দ্রাঘিমারেখাগুলো কোনো সমতলে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এভাবে প্রাপ্ত অভিক্ষেপকে চিত্রানুপাত বা দৃশ্যানুপাত (Pictorial Projection) কিংবা জ্যামিতিক অভিক্ষেপ বলা হয়। এগুলোকে স্বাভাবিক অভিক্ষেপও বলা হয়। কিন্তু অক্ষ ও দ্রাঘিমারেখাগুলোকে গাণিতিক হিসাবের সাহায্যে পরিবর্তিত করলে অভিক্ষেপটি বিশেষ গুণ লাভ করে এবং নির্দিষ্ট প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের অভিক্ষেপকে অ-চিত্রানুপাতিক বা অ-জ্যামিতিক অভিক্ষেপ বলা হয়।

মানচিত্র অভিক্ষেপের শ্রেণীবিভাগ: অভিক্ষেপ সাধারণত চার প্রকারঃ

১. বেলনাকার অভিক্ষেপ (Cylindrical Projection)
ভূগোলককে একটি বেলনের মধ্যে স্থাপন করে তার ছায়া প্রতিফলিত করলে যে অভিক্ষেপ পাওয়া যায়, সেটিই বেলনাকার অভিক্ষেপ।

২. শঙ্কুজ অভিক্ষেপ (Conical Projection)
ভূগোলককে কাগজের শঙ্কুর ভেতর স্থাপন করে অঙ্কিত মানচিত্রকে শঙ্কুজ অভিক্ষেপ বলা হয়।

৩. শীর্ষদেশীয় অভিক্ষেপ (Azimuthal Projection)
যখন ভূগোলকের একটি বিন্দুতে সমতল কাগজ স্পর্শ করিয়ে অভিক্ষেপ অঙ্কন করা হয়, তখন তাকে শীর্ষদেশীয় অভিক্ষেপ বলে।
মেরু বিন্দুতে কাগজ স্থাপন করলে → মেরুস্থানীয় অভিক্ষেপ
নিরক্ষীয় রেখা বরাবর স্থাপন করলে → নিরক্ষীয় অভিক্ষেপ
মধ্যবর্তী স্থানে স্থাপন করলে → তির্যক অভিক্ষেপ

👉 আলোক রশ্মির অবস্থানের ভিত্তিতে আবার তিন ভাগঃ
নোমনিক অভিক্ষেপ – আলো ভূগোলকের কেন্দ্র থেকে আসে
স্টেরিওগ্রাফিক অভিক্ষেপ – আলো ভূগোলকের বাইরে থেকে আসে
অর্থোগ্রাফিক অভিক্ষেপ – আলো অনন্ত দূর থেকে সমান্তরালভাবে আসে

৪. গাণিতিক ভিত্তিক অভিক্ষেপ (Mathematical Projection)
গাণিতিক হিসাবের মাধ্যমে দ্রাঘিমা ও অক্ষরেখার দৈর্ঘ্য নির্ণয় করে অঙ্কিত অভিক্ষেপ। এগুলোকে সংরক্ষিত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ঃ
সমআয়তনিক অভিক্ষেপ (Equal-area Projection)
সঠিক আকার সংরক্ষণকারী অভিক্ষেপ (Conformal Projection)
সঠিক দিক সংরক্ষণকারী অভিক্ষেপ (Azimuthal Projection)

বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগের ছক:

ক. অঙ্কন পদ্ধতির ভিত্তিতে
চিত্রানুপাতিক বা দৃশ্যানুগ অভিক্ষেপ
অ-চিত্রানুপাতিক অভিক্ষেপ

খ. ব্যবহৃত বিকাশযোগ্য তলের ভিত্তিতে
বেলনাকার অভিক্ষেপ
শঙ্কুজ অভিক্ষেপ
শীর্ষদেশীয় বা জেনিথাল অভিক্ষেপ
গাণিতিক অভিক্ষেপ

গ. সংরক্ষিত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে
সমআয়তনিক (Homolographic) অভিক্ষেপ
সঠিক আকারসংরক্ষণকারী (Orthomorphic) অভিক্ষেপ
সঠিক দিক সংরক্ষণকারী (Azimuthal) অভিক্ষেপ

ঘ. স্পর্শক তলের অবস্থানের ভিত্তিতে
মেরুস্থানীয় অভিক্ষেপ
নিরক্ষীয় অভিক্ষেপ
তির্যক অভিক্ষেপ

ঙ. দৃষ্টিবিন্দু বা আলোর অবস্থানের ভিত্তিতে
নোমনিক অভিক্ষেপ
স্টেরিওগ্রাফিক অভিক্ষেপ
অর্থোগ্রাফিক অভিক্ষেপ

চ. জ্যামিতিক আকৃতির ভিত্তিতে
আয়তক্ষেত্রাকার অভিক্ষেপ
বৃত্তাকার অভিক্ষেপ
ডিম্বাকার অভিক্ষেপ
প্রজাপতি আকৃতির অভিক্ষেপ

উপসংহার: সার্বিকভাবে বলা যায়, মানচিত্র অভিক্ষেপ হলো পৃথিবীর গোলাকার পৃষ্ঠকে সমতলে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, দিকনির্দেশ ও পরিমাপের উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন অভিক্ষেপ ব্যবহার করলে মানচিত্র আরও সঠিক ও ব্যবহারযোগ্য হয়। তাই ভৌগোলিক গবেষণা ও বাস্তব জীবনের নানা ক্ষেত্রে মানচিত্র অভিক্ষেপের গুরুত্ব অপরিসীম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক