তুলনামূলক সরকার ও তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর


প্রশ্ন : তুলনামূলক সরকার ও তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।

ভূমিকা: তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নের একটি অংশবিশেষ হলো তুলনামূলক সরকার। তুলনামূলক সরকার অধ্যয়নে কেবল একটি দেশের সরকারের গঠন, কাঠামো ও ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। কিন্তু তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নে একটি দেশের সরকার ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনীতির অন্যান্য দিক ও প্রক্রিয়া সম্পর্কেও ধারণা লাভ করা যায়। উভয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকলেও রাজনীতি বিশ্লেষণে দু'টিরই গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

তুলনামূলক সরকার: সাধারণভাবে তুলনামূলক সরকার বলতে বোঝায় এক দেশের সরকারের সাথে অন্য দেশের সরকারের প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে সুবিধা-অসুবিধা চিহ্নিত করা এবং গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

তুলনামূলক রাজনীতি: তুলনামূলক রাজনীতি বলতে বোঝায় একাধিক দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার আচরণ, প্রতিষ্ঠান, প্রক্রিয়া, বৈধতা, মূল্যবোধ ইত্যাদির পারস্পরিক তুলনামূলক বিশ্লেষণ।

তুলনামূলক সরকার ও তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নের পার্থক্য:

১. আলোচনার প্রকৃতিগত পার্থক্য: তুলনামূলক সরকার পদ্ধতির আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র ও তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পর্যালোচনায়। অন্য রাষ্ট্র, বিশেষ করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের প্রকৃতি, ধরন বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা হয় না। অন্যদিকে তুলনামূলক রাজনীতি আধুনিক ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে।

২. পরিধির পার্থক্য: তুলনামূলক সরকার অধ্যয়নে প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় যেমন: রাষ্ট্রীয় কাঠামো, রাজনৈতিক দল, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সামাজিকীকরণ, রাজনৈতিক নিয়োগ, রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম, উপদল, এলিটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকায় পরিধি বিস্তৃত।

৩. কাঠামোর পার্থক্য: তুলনামূলক সরকার অধ্যয়নে কোন নির্দিষ্ট কাঠামো ব্যবহার করা হয় না, শুধুমাত্র বর্ণনামূলক তুলনা করা হয়। তুলনামূলক রাজনীতিতে বৈজ্ঞানিক কাঠামো প্রয়োগ করা হয়। ডেভিড ইস্টন, গ্যাব্রিয়েল এলমন্ড ও জি.বি. পাওয়েলের কাঠামো অনুসরণ করে এটি বৈজ্ঞানিক রূপ লাভ করেছে।

৪. ক্ষেত্রগত পার্থক্য: তুলনামূলক সরকার শুধুমাত্র সরকারের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তুলনামূলক রাজনীতি সরকারের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর পাশাপাশি রাজনীতির ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বেসরকারি কাঠামোও অন্তর্ভুক্ত করে।

৫. আলোচনার ধরনগত পার্থক্য: তুলনামূলক সরকারের আলোচনা বর্ণনামূলক। তুলনামূলক রাজনীতির অধ্যয়ন বিশ্লেষণধর্মী ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক, যা অধিক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য।

৬. বৈজ্ঞানিক প্রয়োগগত পার্থক্য: তুলনামূলক সরকার আলোচনাভিত্তিক, বিশ্লেষণভিত্তিক নয়। তুলনামূলক রাজনীতি বস্তুনিষ্ঠ, যুক্তিনির্ভর ও মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ কাঠামো প্রয়োগ করে।

৭. বিষয়গত পার্থক্য: তুলনামূলক সরকারের বিষয় আইনস্বীকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের তুলনামূলক আলোচনা। তুলনামূলক রাজনীতিতে আইনস্বীকৃত বিষয়ের পাশাপাশি রাজনীতির ওপর প্রভাব বিস্তারকারী সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত।

৮. আনুষ্ঠানিকতার পার্থক্য: তুলনামূলক সরকার আলোচনায় আইনানুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তুলনামূলক রাজনীতি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় বিষয়ের তুলনামূলক অধ্যয়ন করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে বলা যায় যে তুলনামূলক সরকার ও তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়নের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কারণে তুলনামূলক রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে তুলনামূলক সরকার পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে দুর্বল। তবে রাজনীতি অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণে উভয় পদ্ধতিরই প্রয়োজন, একটি বাদ দিয়ে অন্যটি যথাযথভাবে কার্যকর হতে পারে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক